শরণার্থীদের করুণ জীবনচিত্র আরেকবার বিশ্ববাসীর সামনে উঠে এসেছে। সম্প্রতি, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি নৌকা ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের কাছে পৌঁছেছে। গত সাত মাসের মধ্যে প্রথম কোন রোহিঙ্গা নৌকার দেশটির উপকূলে ভেড়ার ঘটনা। ১৬৫ জন নারী পুরুষ এবং শিশু নিয়ে নৌকাটি গত ১৭ দিন ধরে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে টিকে ছিল। নৌকায় তীব্র খাদ্য ও জ্বালানি সংকট থাকায় শরণার্থীদের অবস্থা অত্যন্ত জটিল। ইতিমধ্যেই বিরূপ আবহাওয়া ও খাদ্য সংকটের কারণে একজন রোহিঙ্গা নারী নৌকাতেই মারা গেছেন। মহিলার সন্তানরা অনাথ অবস্থায় এখন নৌকার অন্যান্য শরণার্থীদের সাথে রয়েছেন।
যাত্রার সূচনা
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করেছিল ১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল থেকে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের এই উপকূলটি মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। এর আগে এই উপকূলের বিভিন্ন শিবিরে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এই শরণার্থী শিবিরগুলোয় জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাই দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্র্য, খাদ্য সংকট এবং নিরাপত্তাহীনতা রোহিঙ্গাদের এই বিপদসঙ্কুল পথে যাত্রা করতে বাধ্য করে।
নৌকাটি প্রথমে থাইল্যান্ডের উপকূল ধরে আন্দামান সাগরের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। পরে এটি মালয়েশিয়ার উপকূল হয়ে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের সুমাত্রা দ্বীপের উত্তর-পূর্ব উপকূলে এসে ভীরে। কঠিন আবহাওয়া এবং সামুদ্রিক ঢেউয়ের কারণে সমুদ্রপথে রোহিঙ্গাদের দিনগুলো অনেক কষ্টে কেটেছে।
নিষ্ঠুর পাচারকারীদের ফাঁদ
এই যাত্রায় পাচারকারীদের নিষ্ঠুরতা ছিল অন্যতম বড় ধাক্কা। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের শেষ সম্বল দিয়ে পাচারকারীদের টাকা দিয়েছিল। এই আশায় যে পাচারকারীরা রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কোন উপকূলে পৌঁছে দেবে। কিন্তু মাঝসমুদ্রে পাচারকারীরা তাদের নৌকাটি ফেলে রেখে অন্য নৌকায় করে পালিয়ে যায়। তারা শরণার্থীদের কোনো জ্বালানি বা পর্যাপ্ত খাবার ছাড়াই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এমন পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পূর্বেকার সমুদ্র যাত্রাগুলোতেও দেখা গেছে। যাত্রা পথে অসহায় মানুষগুলোকে ধোঁকা দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
জীবনের জন্য লড়াই
হাজার প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীবাহী সেই নৌকাটি ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় প্রবেশ করে নোঙর করার অনুমতি না পাওয়ায় শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে জাকার্তা শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
রোহিঙ্গাদের আশঙ্কা, যদি নৌকাটি স্রোতে ভেসে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে চলে যায়, তবে তাদের জীবনের আর কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না। তাছাড়া খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট, রোগব্যাধি এবং মৃত্যুর শঙ্কা রোহিঙ্গাদের দিনদিন দুর্বল করে দিচ্ছে।
কঠিন মানবিক সংকট
উল্লেখ্য, এই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে এমন অনিশ্চিত যাত্রা করলেও, তারা মূলত সবখানেই কঠিন মানবিক সংকটের মুখোমুখি। একদিকে শরণার্থী শিবিরের কঠিন জীবন, খাদ্য সংকট, জ্বালানি সংকট আর অন্যদিকে আরাকান আর্মির সশস্ত্র সহিংসতায় রোহিঙ্গারা উভয় সঙ্কটে ভুগছে। ফলে রোহিঙ্গারা সমুদ্র পথে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু পালিয়ে আসার পরও তাদের দুঃখের যেন কোন শেষ নেই। ইতোমধ্যে একজন রোহিঙ্গা মা ক্ষুধা ও রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেছেন আর তার সন্তানরা এখন নৌকায় অন্য শিশুদের সাথে অনাথ হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।
এই কাহিনী শুধুমাত্র ভাসমান নৌকায় ভেসে থাকা কিছু মানুষের কাহিনি নয়। বরং এটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি। তারা গত কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে জীবন যাপন করছে, কিন্তু সেই জীবনও ছিল চরম কষ্টকর। এদিকে বাংলাদেশেও তাদের অবস্থান দিন দিন আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে। যার ফলে রোহিঙ্গারা এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে বাধ্য হয়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
উল্লেখ্য, গত সাত মাসের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে ভেড়া এটিই প্রথম কোন রোহিঙ্গা শরনার্থীবাহী নৌকা। এর আগে, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে কয়েকটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নৌকা একইভাবে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে পৌঁছেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিলাবোহ শহরের উপকূলে একটি নৌকা ডুবে গিয়ে বহু শরণার্থীর মৃত্যু হয়। এই দুঃখজনক ঘটনা সেই সময় বিশ্বকে স্তব্ধ করেছিল।
এর বাইরে ২০০৯ সাল থেকে আচেহ উপকূলে কমপক্ষে ৪০টিরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নৌকা এসে পৌঁছেছে। এদের মধ্যে বেশীরভাগই মিয়ানমার বা বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই মানবিক সংকট থেকে রক্ষা করতে আন্তর্জাতিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকটের সুষ্ঠু সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ বর্তমানে ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে, যাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করছে।
সূত্র : আল জাজিরা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক#molongui-disabled-link
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক#molongui-disabled-link
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক#molongui-disabled-link
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক#molongui-disabled-link