নিউজনেস্ট

গাজা যুদ্ধে পশ্চিমা মিডিয়ার একচোখা নীতি

গাজা যুদ্ধে পশ্চিমা মিডিয়ার একচোখা নীতি
গাজা যুদ্ধে পশ্চিমা মিডিয়ার একচোখা নীতি। ছবি: কুদস এন

আজকের বিশ্বের সংঘাতগুলোতে গভীর প্রভাব ফেলছে। গাজায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং গণহত্যায় পশ্চিমা গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। ইউরোপীয় ও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো কিভাবে এই সহিংসতাকে আড়াল করে দখলদারিত্বকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা আজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সাংবাদিকতায় পক্ষপাতমূলক শব্দ ব্যবহার

গাজা যুদ্ধে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের প্রচারিত সংবাদে এমন ভাষা ব্যবহার করছে যা ইসরায়েলি দখলদারদের স্বার্থ রক্ষা করে। বিশেষ করে ইসরায়েলিদের ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে ‘হত্যা’, ‘গণহত্যা’, ‘নৃশংসতা’ এ ধরনের আবেগী শব্দগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে পশ্চিমা মিডিয়া। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলা মারাত্মক নৃশংসতার বর্ণনার ক্ষেত্রে চলছে এমন শব্দগুলো একেবারেই অনুপস্থিত। ফলস্বরূপ, ইসরায়েলি বর্বরতাকে হালকা করে দেখানো হচ্ছে আর ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগকে অল্প ও গুরুত্বহীন করে তোলা হচ্ছে।

সংঘাতের মূল ইতিহাসকে মুছে ফেলা

৭ অক্টোবর ২০২৩ এর হামাসের ‘তুফানুল আকসা’ অভিযানের পরে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এই ঘটনাকে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের সূচনা বিন্দু হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে। অথচ এর পেছনের বাস্তবতা অনেক গভীর এবং দীর্ঘকালীন। ফিলিস্তিন ভূমি ১৯৪৮ সাল থেকেই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইয়েলের দখলে এবং গাজা অবরোধের শিকার গত ১৭ বছর ধরে। তাই কারও পক্ষেই এই প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করে সংঘাতের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্ত পশ্চিমা মিডিয়া ইতিহাসের এই নির্মম সত্যগুলোকে খুব সহজেই আড়াল করে সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে ঐতিহাসিক ৭ই অক্টোবরকে চিহ্নীত করে হামাসের কার্যকলাপকে দোষারোপ করে আসছে।

দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য ইকোনমিস্টের একমুখী বিবরণ

বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান এবং ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট ৭ অক্টোবরের ঘটনার বর্ণনায় ‘রক্তাক্ত’ ও ‘রক্তপিপাসু’ শব্দ ব্যবহার করলেও, ইসরায়েলি বাহিনীর গাজায় বোমাবর্ষণ করে অসংখ্য নিরীহ ফিলিস্তিনিকে হত্যার ঘটনাকে  ‘সামরিক অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করছে। এছাড়া একদিকে  হামাসের যে কোন প্রতিরোধ প্রক্রিয়াকে ‘সন্ত্রাসী আক্রমণ’ বলে অভিহিত করার পাশাপাশি দখলদার ইসরায়েলের সকল অবৈধ ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া হিসেবে তুলে ধরছে দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য ইকোনমিস্ট। ফলে এই একমুখী পক্ষপাতদুষ্ট নীতি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর নিরপেক্ষতার অভাবকে খুলে খুলে প্রকাশ করে দিচ্ছে।

ডয়চে ভেলের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে প্রশ্ন

গত ১৬ই অক্টোবর ২০২৩ তারিখে জার্মান চ্যানেল ডয়েচে ভেলে তাদের ওয়েবসাইটে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল: ‘কোন কাজগুলো যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত?’ এই নিবন্ধে তারা দাবি করে ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। যা গাজার অবস্থা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বনের আরো একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। সেইসাথে পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুকে শুধুই সংখ্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও, ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের বিশদ বিবরণ তুলে ধরা হচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলোয়।

বিবিসির বিভ্রান্তিকর শব্দ প্রয়োগ

ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিবিসি’র রিপোর্টিংয়ে ব্যবহৃত ভাষাতেও বিশাল পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। বিবিসির রিপোর্টিংয়ের ভাষাতেও ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হওয়ার সংবাদে ‘কিলড’ বা ‘হত্যা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, অথচ ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুতে শুধুমাত্র ‘মৃত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যা মূলত ইসরায়েলিদের প্রাণকে অতিমূল্যায়ন এবং ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি সুস্পষ্ট অবজ্ঞা। একই সঙ্গে বিবিসি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে ‘দ্বিপাক্ষিক বিরোধ’ হিসেবে উপস্থাপন করে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বাস্তবতাকে পুরোপুরি ধামাচাপা দেয়।

পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ

পশ্চিমা গণমাধ্যমের এই ধারাবাহিক পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদে ইতিমধ্যে প্রতিবাদ করে নিজেদের পেশাগত অবস্থান ত্যাগ করেছেন কিছু সাংবাদিক। সম্প্রতি ইতালীয় সাংবাদিক রাফায়েল ওরিয়ানি ‘লা রিপাবলিকা’ পত্রিকা থেকে পদত্যাগ করত:বলেন, ‘গাজায় যে গণহত্যা চলছে, তাতে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের সুরক্ষা না থাকলে তা সম্ভব হতো না। আমরাই এই সুরক্ষা প্রদান করছি।’

এছাড়া ফিলিস্তিনের পক্ষে বলার কারণে অথবা ইসরায়েলি দখলদারিত্বের সমালোচনার কারণে বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বরখাস্ত করার ঘটনা ঘটেছে। জার্মান ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘ডয়চে ভেলে’ এমন সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করেছে যারা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন এবং নিজেদের কর্মীদের ইসরায়েলের ‘অস্তিত্বের অধিকার’ সমর্থন করতে বাধ্য করছে ডয়েচে ভেলে।

নিরপেক্ষতা না পক্ষপাতদুষ্ট মূলক প্রচারণা: কোনখানে মিডিয়ার দায়বদ্ধতা?

ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তাদের নিরপেক্ষতা কতটা বজায় রাখতে পেরেছে, সেটি আজ দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। অথচ এই গণমাধ্যমের ভূমিকাতো ছিল কোনো নির্দিষ্ট পক্ষকে সমর্থন দেওয়া নয়, বরং সত্য এবং নিরপেক্ষ সংবাদ প্রদান করা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের অনেকাংশ যেন প্রোপাগান্ডার যন্ত্র হিসেবে কাজ করছে। যা ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেয় এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাহিনীর সংগ্রামকে সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করে।

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত