সিরিয়ার ইতিহাসে এটি যেন এক নতুন ভোর। স্বৈরশাসনের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কণ্ঠে হর্ষধ্বনি, ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা-আকাঙ্ক্ষা আর বিশ্লেষণের ঢেউ। কিন্তু এই মুহূর্তের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক এবং মানবিক দৃশ্য ছিল সেই হাজারো বন্দীর মুক্তি, যারা বছরের পর বছর বন্দীশালার অন্ধকারে কাটিয়ে ভেবেছিল, এই দুঃস্বপ্নের চৌকাঠ তারা কখনোই পেরোতে পারবে না।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের স্লোগান যতই জোরালো হোক না কেন, বাস্তবতার মাটিতে সেই স্লোগানগুলো অনেক সময় ব্যর্থ হয়। বাশার আল আসাদের শাসনে থাকা সিরিয়া যেন এই ব্যর্থতার সবচেয়ে করুণ উদাহরণ।
২৫ বছর ধরে বাশার আল আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতায় আসীন। এর আগে তার বাবা হাফেজ আল আসাদ দেশটি শাসন করেছেন তিন দশকেরও বেশি সময়। এই দীর্ঘ শাসনামলে সিরিয়া পরিণত হয়েছে এক নির্মম স্বৈরশাসনে। এখানে শুধু জনগণের স্বাধীনতা ও ন্যায়ের অধিকার নয়, বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারও বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে।
হামা গণহত্যা
১৯৮২ সালে হামা গণহত্যা তারই একটি নির্মম উদাহরণ। মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে শহরের বাসিন্দাদের ওপর চালানো হয় ভয়াবহ সামরিক অভিযান। এতে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস প্রমাণ করেছে, অন্তত ১০ হাজার মৃত্যুর ঘটনা। নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে আরও চার হাজারের বেশি।
আরব বসন্তের নির্মম ফল
বাবার পথ অনুসরণ করে বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় এসে জনগণের ওপর আরও কঠোর শাসন চালান। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ যখন সিরিয়ায় আছড়ে পড়ে, তখন সাধারণ মানুষ পরিবর্তনের দাবিতে পথে নামে। এর উত্তরে ছিল ভয়ংকর দমনপীড়ন। এই দমনযজ্ঞে লাখো মানুষ নিহত হয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে মিলিয়নেরও বেশি মানুষ। কেউ শরণার্থী, কেউ দেশে থেকেই ভিটেমাটি হারিয়েছে।
শিশু গণহত্যা
শাসকের নিষ্ঠুরতা এতটাই নির্মম ছিল যে শিশুদেরও রেহাই মেলেনি। দারা শহরের একদল শিশু স্কুলের দেয়ালে লিখেছিল, ‘শাসনের পতন চাই!’ এই অপরাধে তাদের গ্রেপ্তার করে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় হাজার শিশুকে। এখনো নিখোঁজ বহু শিশু।
এই ঘটনাগুলো জনরোষ বাড়িয়ে তোলে। এক সময় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় সশস্ত্র বিদ্রোহে। বাশার আল আসাদ যখন পতনের দ্বারপ্রান্তে, তখনই ইরান, হিজবুল্লাহ ও রাশিয়ার সহায়তায় টিকে থাকেন ক্ষমতার মসনদে।
সিরিয়ার কারাগারগুলো যেন মৃত্যুর কারখানায় পরিণত হয়েছিল। বন্দীদের ওপর চালানো হতো ভয়ংকর নির্যাতন। ২০১৫ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব কারাগারের নির্মম চিত্র। ২০১৭ সালে ‘কাইসার’ নামে এক সামরিক আলোকচিত্রী হাজারো ছবি ফাঁস করেন। সেই ছবিগুলোতে ফুটে ওঠে বন্দীদের ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতন। ছবি দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা বিশ্ব।
শেষ পর্যন্ত ঝড়ের মতো এক বিপ্লব সিরিয়ার স্বৈরশাসনকে উল্টে দেয়। হাজারো বন্দী মুক্তি পায়। তাদের চোখেমুখে আনন্দ আর বিস্ময়ের মিশ্রণ। বন্দীদের প্রথম কণ্ঠ ছিল নির্যাতনের কাহিনিতে পরিপূর্ণ। তারা বলছিল নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও কীভাবে নৃশংসতার শিকার হয়েছিল! অনেকের শরীরে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন, যা তাদের কষ্টের অগ্নিপরীক্ষার সাক্ষী।
প্রথম মুহূর্তগুলো ছিল আনন্দে ভরপুর। কিন্তু সেই আনন্দের পেছনে লুকিয়ে ছিল স্মৃতির গভীর ক্ষত। মানুষ এতদিন ধরে কারাগারে কীভাবে বেঁচে ছিল, তা সত্যিই এক বিস্ময়!
এই মুক্তি শুধু একটি স্বৈরাচার পতনের নয়, এটি ছিল মানবতার জয়। বন্দীদের মুখে হাসি ফোঁটানো, পরিবারে ফিরে আসার মুহূর্তগুলো যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। এই অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্যায় আর নির্যাতনের শেকল যতই শক্ত হোক, জালেমের পতন একদিন না একদিন হবেই।
সূত্র: আল জাজিরা