বাংলাদেশে মাদক ও সন্ত্রাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অভিযোগ করা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে ইয়াবার বিস্তার ঘটানো হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য ছিল দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করা এবং অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেওয়া।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইয়াবা ব্যবসার অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আলোচিত ইয়াবা গডফাদার আবদুর রহমান বদি। শুধু তিনিই নন, আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার নামও উঠে এসেছে এ চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে।
দীর্ঘ অনুসন্ধান ও স্থানীয় সূত্রের বরাতে অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহিদুল হকের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতা করার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ তিনজন নিয়মিত ইয়াবা ব্যবসা থেকে বড় অঙ্কের কমিশন নিতেন।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের কিছু নেতার পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে বিষয়টি জানানো হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি, বরং সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করেছেন। এ কারণেই মাদক বিস্তারে তার নীরব সম্মতি ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিষয়ে মুখ খোলার কারণেই হত্যা করা হয় আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ী হাজি সাইফুল আলমকে। পুলিশের ‘সেফ হোম’-এ থাকার সময় পরিকল্পিতভাবে তাকে বের করে হত্যা করা হয়।
অন্যদিকে, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বহু মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হলেও মূল গডফাদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের আগে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আবদুর রহমান বদি ও তার স্ত্রী শাহীন আক্তার চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিল। তবে ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামালের হস্তক্ষেপে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বদির ইয়াবা ব্যবসা থেকে নিয়মিত কমিশন পেতেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও শহিদুল হক। কিন্তু ক্ষমতার ছায়ায় তারা সব সময় আইনের আওতার বাইরে থেকেছেন।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা মাদক ব্যবসার বিষয়ে শেখ হাসিনাকে অবহিত করলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গণভবনে গিয়ে বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন, ‘আপনাদের সময়েই তো মাদক এসেছে দেশে। এখন এত কথা বলার দরকার নেই!’
২০১৯ সালে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণের জন্য যোগাযোগ করেন আলোচিত মাদক ব্যবসায়ী সাইফুল আলম। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও শহিদুল হকের নাম প্রকাশ করেন। এরপরই কুখ্যাত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে সাইফুলকে ‘সেফ হোম’ থেকে বের করে হত্যা করা হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে সাইফুলকে হত্যা করা হয়, যাতে তার নাম প্রকাশ না পায়। এছাড়া, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ওসি প্রদীপের আমলেই টেকনাফে পুলিশের ক্রসফায়ারে ১৪৪ জন নিহত হয়েছেন।
আবদুর রহমান বদির ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, তিনি শুধু মধ্যস্থতাকারী ছিলেন, যিনি সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের কমিশন পৌঁছে দিতেন। তার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হতো।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বদির সঙ্গে শুধু উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা নন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেও জড়িত ছিলেন। তাদের লাভের অংশ উচ্চপর্যায়ে পৌঁছাত বলেই রাষ্ট্রযন্ত্র মাদকের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।’
অভিযুক্তদের মধ্যে আবদুর রহমান বদি ও শহিদুল হক কারাগারে থাকলেও ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামাল আত্মগোপনে আছেন, তাই তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে মাদক ও সন্ত্রাসের শেকড় কতটা গভীরে প্রোথিত, তা এ গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী পদক্ষেপ নেয় এবং আদৌ কোনো উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় কি না।