নিউজনেস্ট

জুমার বয়ানে যা বললেন জাতীয় মসজিদের খতিব

অভ্যুত্থানে নিহতদের শহিদ বলার ব্যাপারে যা বললেন আব্দুল মালেক সাহেব
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব। ছবি: সংগৃহীত

গতকাল শুক্রবার জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমে দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া জুমার বয়ানে তাকওয়া, পরকালীন জীবন এবং চলমান জাতীয় ইস্যু ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনের অফিস খোলাসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করেন জাতীয় মসসজিদের খতিব মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব।  

তাকওয়ার আলোচনার শুরুতেই পবিত্র কুরআন থেকে একটি আয়াত পাঠ করেন খতিব মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব। যে আয়াতের অর্থ হচ্ছে: ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর! এবং আগামীকালের জন্য  কী অগ্রিম পাঠিয়েছ তা নিয়ে প্রত্যেকেই ভাবো।’

তিনি বলেন, ‘উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ শুরুতেই আমাদেরকে ‘হে মুমিনগণ’ বলে সম্বোধন করেছেন। এটা মোহাব্বতের আবেদনপূর্ণ একটি ভাষা। এ আহ্বানের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। আর ঈমানের অন্যতম নির্দেশনা হলো, তাকওয়া অর্জন করা। এর পরে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো’। এই আদেশে মুমিনদের তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে।

তাকওয়া মানে কি?

তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে: আল্লাহর নেয়ামতকে স্মরণ করে, তার সামনে উপস্থিত হওয়াকে মনে ধারণ করে, আল্লাহর নির্দেশিত সকল বিধান পালন করা। পাশাপাশি সকল হারাম কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। তাকওয়া অবলম্বনের মানে, মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য দুনিয়ায় অবিশ্রান্ত কাজ করে যাওয়া। তাকওয়া মানে শুধু ভয় নয়। যে ভয়ের পর করণীয় কিছু থাকে না, সেটাকে তাকওয়া বলে না।

পরকাল

এরপর আয়াতের তৃতীয় অংশ: (অর্থ) ‘আগামীকালের জন্য তোমরা কী অগ্রিম পাঠিয়েছ তা ভাবো’ এর ব্যাখ্যায় খতিব মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব বলেন, ‘এই আয়াতে ‘আগামীকাল’ শব্দ উল্লেখ করে বোঝানো হচ্ছে, আখেরাতের দীর্ঘ জীবনের তুলনায় পুরো দুনিয়ার সময় একদিনের মতো অথবা তার চেয়েও কম। আয়াতের এই অংশে কিয়ামত দিবসের জন্য কী প্রেরণ করা হয়েছে, তা নিয়ে মুমিনদের চিন্তা করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে মুমিনের আসল জীবন আখেরাত; দুনিয়া নয়।’

আয়াতের সাথে খতিব মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব সহীহ বুখারী থেকে একটি হাদিস পাঠ করেন। যার অর্থ হচ্ছে: যখন তুমি সকালে উপনীত হবে, তখন সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। আর যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে, সকালের অপেক্ষা করো না। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪১৬]

উল্লেখিত হাদিসটির প্রেক্ষিতে খতিব মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব উপস্থিত মুসল্লিদের প্রশ্ন করে বলেন, ‘আখেরাতের কী প্রস্তুতি আছে? এসেছি খালি হাতে। নিয়ে যাবো কী? কিছু তো নিতে হবেই। খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না। তাই এখনই আমল করার মোক্ষম সময়। কারণ, মৃত্যুর পরেই দেখা যাবে আমি আপনি জান্নাতের আমল পাঠিয়েছি না জাহান্নামের আমল পাঠিয়েছি?’

খতিব সাহেব আরো বলেন, ‘কবর থেকেই শুরু হবে প্রশ্ন। তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কী? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনো কিনা? এগুলো আরবিতে মুখস্থ করলেও কবরে জবাব দেয়া সম্ভব না। এই তিন প্রশ্নের উত্তর আমাদের জীবনে থাকতে হবে। যদি সত্যিকার অর্থে নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আরবি না জানলেও কবরে গিয়ে আরবিতে উত্তর দেওয়া সম্ভব হবে।’ এ জন্য আমাদের করণীয় হল: ‘আমরা সবকিছুতে আল্লাহর শরিয়ত, নবীজি  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ, সিরাতের অনুসরণ করব। কোন তন্ত্র-মন্ত্রের অনুসরণ করবো না। বিদআতের দিকে যাবো না।’

জুলুম থেকে বেঁচে থাকা

এরপরে খতিব আব্দুল মালেক সাহেব বলেন, আমরা এখন তাকওয়ার ২টি প্রকাশ ক্ষেত্র নিয়ে আজকে আলোচনা করবো। প্রথমত জুলুম থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো। কেননা জুলুম কেয়ামতের দিন বহু অন্ধকারের কারণ হবে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৫৭৮]

‘জুলুম চাই তা সামান্যই হোক না কেন, একজনের উপর জুলুম বা একাধিক ব্যক্তির উপর জুলুম সর্বক্ষেত্রেই জালেমের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। অত্যাচারীর জীবনে কোন আলো থাকবে না। কোন লোকের উপর কেউ সামান্যতম জুলুম করলে মাজলুম ব্যক্তি যদি সেটা ক্ষমা না করে, তাহলে কবরে এর জন্য জালেমকে শাস্তি পেতে হবে। তাহলে যারা কোটি কোটি মানুষের উপর জুলুম করে, তাদের কী হবে? তাদের জুলুম হাশরে কী হয়ে দাঁড়াবে? মিযানে কী হবে? পুলসিরাতে কী হবে? আখেরাত নষ্ট করে সামনে আগানোর মধ্যে কোন লাভ নেই।

বাজার সিন্ডিকেট একটি জুলুম

জুলুমের আলোচনার সূত্র ধরে খতিব আব্দুল মালেক সাহেব বাজার সিন্ডিকেট সম্পর্কেও আলোচনা করেন। তিনি বিলেন, জুলুমের অন্যতম প্রকাশক্ষেত্র হলো দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়া। বর্তমানে যে বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম, এগুলো কি এমনেই? এসব সিন্ডিকেট কি জুলুম নয়? গরিব মানুষের উপর জুলুম নয়? ১৪০০ বছর আগে সিন্ডিকেট বলতে কিন্তু কিছুই কল্পনা করা যেত না। কেউ কোনো জায়গায় সিন্ডিকেট করলে, কঠিন শাস্তির কাজ হিসেবে গণ্য হতো এটা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোর শাস্তি দিয়েছেন।

হাদিসে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো এবং এর মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার ব্যাপারে কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে। হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসনাদের আহমাদের সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোন বাজারে অন্যায়ভাবে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাকে আগুনের বড় জায়গায় বসিয়ে শাস্তি দিবেন।  [মুসনাদে আহমাদ: ১৯৯০৯]

হাদিসে এই দাম বাড়িয়ে দেওয়ার শাস্তি; ব্যক্তি চক্রান্তে দাম বাড়ানোর উপর প্রজোয্য। স্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ার উপরে নয়। সুতরাং বর্তমানের এসব সিন্ডিকেটগুলো হারাম কাজ। কবিরা গুনাহ। এগুলো জুলুমের উপর সিন্ডিকেট। গরিবের উপর জুলুমের সিন্ডিকেট। সুদ যেমন হারাম, চুরি ডাকাতি যেমন হারাম, সিন্ডিকেট করে অস্বাভাবিক গতিতে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়াও হারাম। বর্তমানের অতিরিক্ত মুনাফার আশায় সিন্ডিকেটকারীদের অতিরিক্ত উপার্জন পরিষ্কার হারাম।

আল্লাহর বিধান হুবহু মানা

তাকওয়ার প্রথম প্রকাশক্ষেত্র সম্পর্কে বিশদ আলোচনার পর খতিব আব্দুল মালেক সাহেব তাকওয়ার দ্বিতীয় প্রকাশক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তাকওয়ার দ্বিতীয় প্রকাশক্ষেত্র হচ্ছে; আল্লাহ যেভাবে বিধান দিয়েছেন, সেভাবেই বিধান মানা।

এই আলোচনার শুরুতে খতিব আব্দুল মালেক সাহেব বলেন, আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার প্রথম আয়াতে বলেন: ‘হে লোক সকল! যে প্রতিপালক এক ব্যক্তি হতে তার স্ত্রী ও তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এবং যিনি পৃথিবীতে উভয়ের থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। তোমরা সেই আল্লাহকে ভয় কর, যে রবের উসিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক, সে আল্লাহকে তোমরা ভয় কর। তোমরা আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)কে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।

সুতরাং আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি আদম এবং হাওয়া আলাইহিমাস সালাম থেকে পুরুষ এবং নারী সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা পুরুষের জন্যও বিধান দিয়েছেন, নারীদের জন্যও দিয়েছেন। তাই পুরুষের পুরুষ থাকা এবং পুরুষের জন্য আল্লাহর সকল বিধান পালন করা ফরজ। এমনিভাবে নারীর জন্য নারী থাকা এবং নারী হিসাবে আল্লাহর সকল বিধান পালন করা ফরজ।’

সমকামিতা একটি রুচিবিরুদ্ধ ঘৃণ্য অপরাধ

এরপর আলোচনার এক পর্যায়ে খতিব মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব এলজিবিটিকিউ ইস্যুতে মানুষকে সচেতন করে বলেন, ‘মহিলা যদি বলে আমি পুরুষ, পুরুষ যদি বলে আমি মহিলা, এটা কি তাকওয়া হলো? নাকি আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ? এগুলো হারাম, কবিরা গুনাহ। এলজিবিটিকিউ বা সমকামিতা একটি রুচিবিরুদ্ধ ঘৃণ্য অপরাধ। এই অপরাধকে কোন মুসলমান সমর্থন করতে পারে না।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন প্রসঙ্গে

এরপর তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন অফিস এই দেশে তাদের দফতর খুলতে চাচ্ছে। যতটুকু জানি, বাংলাদেশ সরকার এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। আশা করি, সরকার এগুলোর অনুমতি দিবে না। তাছাড়া এই মুসলিম দেশে জাতিসংঘ এটা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এটা সম্ভব হতে দেয়া যাবে না’

বক্তব্যের এই পর্যায়ে এসে খতিব মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনকে প্রশ্ন করে বলেন, তারা কীভাবে এই দাবী করতে পারে? যদি তারা বাস্তবেই মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতো, তাহলে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপরে জুলুম বহু আগেই তারা থামাতে পারত। যে জাতিসংঘ ইসরায়েলের জুলুম থেকে ফিলিস্তিনের শিশুদের রক্ষা করতে পারেনি, যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি, এমনকি অনুরোধ করে গাজায় ঔষধ ও খাবার পর্যন্ত প্রবেশ করাতে পারেনি তারা কিভাবে মানবাধিকারের কথা বলে?

‘আমরা অধিকার জানবো কুরআন সুন্নাহ থেকে। কোনটা অধিকার কোনটা অধিকার না, এটা যাদের কাছে ইসলাম নাই তারা জানাবে? মানবাধিকার শিখতে হবে আল্লাহর কুরআন এবং রাসূলের সুন্নাহ থেকে। আমরা রাসূলের আদর্শ নিজেরা বাস্তবায়ন করব এবং এর দাওয়াত সর্বত্র ছড়িয়ে দিব। ইনশাআল্লাহ।’

বয়ানের পর আরবি খুতবাতেও মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব তাকওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরেন। এবং জুমার নামায শেষে মুনাজাতে দেশের জন্য এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন।

সাদিক শাহরিয়ার
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত