ঠিক ঘড়িতে সময় তখন ১২ টা বেজে ৩৪। সম্মানিত খতীব মুহতারাম আব্দুল মালেক সাহেব মিম্বারে আরোহণ করেন। সবাইকে সালাম পেশ করে… হামদ সানা পাঠ করেন। হামদ ও সালাম শেষে খতীব সাহেব বলেন, ‘আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের হায়াত দান করেছেন। হায়াত এবং মওতের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা তিনিই। তাঁর মেহেরবানিতেই আমরা জীবিত আছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য যে কয়দিনের হায়াত নির্ধারণ করেছেন, আমরা কেবল সেই সময় পর্যন্তই বেঁচে থাকব। এরপর কার কখন মৃত্যু হবে, তা কেউ জানে না।’
খতীব সাহেব বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের এক তালেবুল ইলম ভাই হাবিবুর রহমান হঠাৎ ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত নসিব করুন। তিনি স্ত্রী-সন্তান রেখে গেছেন। তার মৃত্যু আমাদের কাছে হঠাৎ মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তা আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত সময়েই হয়েছে।’
এরপরে মুহতারাম একটি প্রচলিত বিভ্রান্তিকর শব্দ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায়ই “অকাল মৃত্যু” শব্দটি ব্যবহার করি, কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। অকাল মৃত্যু বলে কিছু নেই। মৃত্যুর তো নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই, যা আগে বা পরে হতে পারে। মৃত্যুর নির্ধারিত সময় একমাত্র আল্লাহ জানেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন:
لا يستاخرون ساعة ولا يستقدمون
“তারা নির্ধারিত সময় থেকে এক মুহূর্তও পিছিয়ে যেতে পারবে না এবং এক মুহূর্তও এগিয়ে আসতে পারবে না।”
তাহলে এটি স্পষ্ট যে, মৃত্যু কখন হবে তা আল্লাহর কাছেই নির্ধারিত। আমরা জানি না কার মৃত্যুর সময় কখন। তাই “অকাল মৃত্যু” বলা একধরনের ভুল ও অন্যায় কথা। এটি বলা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। হায়াত ও মওতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। আমাদের উচিত হায়াতকে আল্লাহর পথে ব্যয় করা। আল্লাহ তাআলা সূরা মুলকে বলেছেন:
تبارك الذي بيده الملك وهو على كل شيء قدير الذي خلق الموت والحياه ليبلوكم ايكم احسن عملا
“মহান ও বরকতময় তিনি, যার হাতে রাজত্ব; এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনিই মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন—তোমাদের মধ্যে কে উত্তম কাজ করে।”
জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। এই জীবনকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে যারা আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি নেয়, তারাই জান্নাতের হকদার। অন্যদিকে যারা হায়াতের অপব্যবহার করে, তারা আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের উচিত আল্লাহর দেওয়া হায়াতের সঠিক ব্যবহার করা এবং আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন।’
এরপরে সম্মানিত খতীব সাহেব বলেন, ‘আমরা আলোচনা করেছিলাম আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষকে হুকুম করেছেন তাকওয়া অবলম্বন করার জন্য। তাকওয়ার প্রথম সবক হলো, তাওহীদ— লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। তাকওয়ার দ্বিতীয় সবক— আল্লাহর আনুগত্য এবং নবীর আনুগত্য, আল্লাহ তায়ালা নবীকে যে শরীয়ত দিয়েছেন সে শরীয়ত গ্রহণ করা—এটা তাকওয়ার সবক।’
মুহতারাম আরো বলেন, ‘হায়াত এবং মউত কেন? ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۖ (অর্থ: আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামী কালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।) তাকওয়ার তৃতীয় সবক আপনি বলতে পারেন, আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ, আল্লাহর দেওয়া হায়াতকে সুন্দর ভাবে কাজে লাগিয়ে আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা— এগুলো হচ্ছে তাকওয়ার একেবারে প্রথম স্তর।’
এরপরে খতীব সাহেব তাকওয়ার ধারাবাহিক তিনটি স্তর প্রমাণে কুরআন থেকে তিন আয়াত পেশ করেন—
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
أَطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِيعُوا۟ ٱلرَّسُولَ
وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۖ
অর্থ:
১. আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।
২. আল্লাহর আনুগত্য কর আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য কর।
৩. প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামী কালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।
এরপরে মুহতারাম বলেন, ‘জান্নাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করো। কবর থেকেই তুমি যাতে জান্নাতি হতে পারো সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করো। এটা হলো তাকওয়ার সবক। এগুলোর ব্যাপারে আমাদের কী হালত— এটা যাচাই করা জরুরী কিনা? খুব জরুরী।
এরপরে মুহতারাম তুলে ধরেন ইসলাম কী? ইসলামের গুরুত্ব কতটুকু—এবিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মুহতারাম বলেন, ‘তাওহিদ—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلْإِسْلَٰمُۗ
আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য দিন একমাত্র ইসলাম।
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ ٱلْإِسْلَٰمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ
(অর্থ: যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না)
আয়াতের ব্যাখ্যায় মুহতারাম বলেন, ‘ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম, অন্য কোন মন্ত্র-তন্ত্র, ইজম, মতবাদ, মতাদর্শ ধরে কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, আখেরাতের মুক্তি কামনা করে, জান্নাত কামনা করে—فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ—আল্লাহ বলেন, কখনো তাকে সুযোগ দেওয়া হবে না। এটা তার থেকে গ্রহণ করা হবে না। যদি আখেরাতের মুক্তি চায় জান্নাত চায় তাহলে একমাত্র রাস্তা ইসলাম। ইসলাম কি জিনিস ইসলামের প্রথম কথা হল—
لآ إله إلا الله، أقيموا الصلاة، وآتوا الزكاة، وصيام رمضان، والحج
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যাকাত আদায় কর, রমজান মাসে রোজা রাখ, বাইতুল্লাহর হজ কর; এরকম আল্লাহ যা ফরজ করেছেন তা পালন করা, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা থেকে বিরত থাকা।’
এরপরে সম্মানিত খতীব সাহেব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন বর্তমান যুগের ইন্টারফেইথ তথা আন্তঃধর্মীয় ঐক্যের বিষয়ে। তিনি বলেন, ‘আজকাল কিছু অস্পষ্ট কথা বা অস্পষ্ট কুফুরি কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত। এ কারণে ইসলামের অনেক মৌলিক আকিদা, ঈমানের মৌলিক আকিদার ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান হয়ে যান বা অনেকের কাছে অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়। কেন এমন হয়? এসমস্ত অস্পষ্ট পরিভাষা এবং অস্পষ্ট কথার কারণে। যেমন একটা কথা মাঝেমধ্যে এসব কথা শোনা যায়–বিশেষকরে যখন দেশের বিরুদ্ধে দেশের শত্রুদের ষড়যন্ত্র বেড়ে যায়, তখন এ কথাগুলো স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে–সকল ধর্মের ঐক্য—এই কথাটার কী অর্থ? এই কথাটার একটা সঠিক অর্থ আছে, একটা কুফুরি অর্থ আছে। যদি সঠিক কথাটা গ্রহণ করেন তাহলে খুব ভালো একটা দরকার। আর যদি কুফরি অর্থটা গ্রহণ করেন তাহলে ঈমানই থাকবে না।’
আন্তঃধর্মীয় ঐক্যের সঠিক অর্থ কী— এবিষয়ে মুহতারাম বলেন, ‘আন্তঃধর্মীয় ঐক্য, আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি— এটার সঠিক অর্থ হলো, ইনসাফপূর্ণভাবে, জুলুমমুক্তভাবে সকল ধর্মের মানুষ একসাথে বসবাস করা, ইনসাফপূর্ণ সহাবস্থান, জুলুমমুক্ত সহাবস্থান।’ এবিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘দেশটা মুসলিম দেশ। মুসলিম দেশে অনেক অমুসলিম থাকতে পারে। হিন্দু আছে, খ্রিস্টান আছে, অন্যান্য ধর্মালম্বী লোকেরাও আছে। মুসলমানরা তাদের উপর জুলুম করে না, করবেও না— এটাই স্বাভাবিক। কারণ ইসলাম ধর্মে নিষেধ আছে। কার ওপরে জুলুম করা যাবে না। কোন মুসলমানের ওপর জুলুম না করা, কোন অমুসলমানের উপর জুলুম না করা— এটা তো ইসলামের শিক্ষা।’
সকল ধর্মের সহাবস্থানের ক্ষেত্রে করণীয় কী— এবিষয়ে মুহতারাম বলেন, ‘মুসলমানরাও তাদের উপর কোন জুলুম করবে না, আর তারাও মুসলমানদের উপর কোন জুলুম করবে না। তারাও দেশের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করবে না। মুসলিম দেশ । আমরা এখানে আছি, দেশটা আমাদের না। দেশটা মুসলমানদের দেশ; কাজেই এই দেশকে শান্তি শান্তিতে থাকতে দিব না— অমুসলিমরা যদি এরকম ষড়যন্ত্র করে বা তাদেরকে যদি অন্যরা তাদেরকে ব্যবহার করে এটা অন্যায় কিনা? এটা জুলুম কিনা? এটা অন্যায়। এটা জুলুম।’ এবিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘তারা মুসলমানদের সাথে বসে ঐক্যবদ্ধ হবে যে, এই দেশে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করব। এদেশের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে, আমরা ক্ষতি করার সুযোগ দিব না। মুসলমানরা বলবে, তোমরা যদি কারো উপরে কোন জুলুম না করো, শান্তিতে থাকতে দাও, তো তোমরা এখানে নাগরিক। তোমরা থাকো শান্তিপূর্ণভাবে। তারা থাকবে। তারা মুসলমানদের ওপর কোন জুলুম করবে না এবং ওদের উপরেও কেউ জুলুম করবে না।’
অমুসলিমদের করণীয় কী— এবিষয়ে মুহতারাম বলেন, ‘দেশের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রকে তারা কাউকে কোনো সুযোগ দিবে না। নিজেরাও ষড়যন্ত্র করবে না। কেউ তাদেরকে যদি ভুল ব্যবহার করতে চায়, তারা সেই সুযোগ দিবে না। এই অর্থে আন্তঃধর্মীয় ঐক্য, সমস্ত ধর্মের লোকদের ঐক্য ঠিক আছে। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু এই ঐক্যের অর্থ যদি ভুল ব্যবহার করা হয়, তো এটা হবে অন্যায়। ক্ষেত্র বিশেষে এটা কুফর হারাম। পাপ তো বটেই, কুফর।’
এরপরে সম্মানিত খতীব সাহেব আলোচনা করেন বহুল প্রচলিত একটি কুফুরী বাক্যের ব্যবহার নিয়ে। তিনি বলেন, ‘এখন কেউ যদি বলে ধর্ম যার যার, উৎসব সবার— এই কথা কেউ বলে কিনা? এ কথাটা কি সঠিক? ভুল। সাধারণ ভুল না, বরং কঠিন ভুল। এটা কুফরী কথা।’
এবিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানে সম্মানিত খতীব সাহেব বলেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব ও তার তার। এক ধর্মের উৎসব সবার উৎসব—এই ধারণা ঠিক না। অন্য ধর্ম যে অবলম্বন করতে চায়, করুক! তাদের ধর্ম সম্পর্কে তারা জানে। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে তো মুসলিম উম্মত জানে, নাকি? আমাদের ইসলাম এবং ইসলামী শরীয়তের ঘোষণা যে, অন্য জাতিদের কোন উৎসব—আমাদের মুসলিম উম্মতের উৎসব না। আমাদের নবী হযরত মুস্তফা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন,
لكل قوم عيد وهذا عيدنا
সকল জাতির নিজস্ব নিজস্ব উৎসব আছে। এবং এই যে ঈদুল আযহা, ঈদুল ফিতর—এটা এটা হল আমাদের ঈদ, আমাদের উৎসব। আমাদের উৎসব হলো ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা। অন্য ধর্মের উৎসব আছে—এটা তাদের উৎসব, আমাদের না। আমাদের উৎসব হল ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিতর।’
এমন সময়ে একব্যক্তি হুজুরের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করতে থাকলে হুজুর রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘আরে ভাই কেন? বারবার নিষেধের পরেও কেন এই কাজটা করেন আপনারা? আপনারা মনে করেন, হুজুর আর কত বলবে! এবার আমরা উঠানো শুরু করি। আপনি যতবার উঠাবেন, আমার নজরে পড়লে আমি নিষেধ করব। আপনি বলতে পারেন যে আপনার ছবি দেখা যায়, আমরা ইন্টারনেটে আপনার ছবি দেখি। আমার ছবি দেখেন— সেটা কি আমি উঠাই? আমি পছন্দ করি? আমি কাউকে বলি? আমিসবসময় নিষেধ করি। এখন যে ভালো মানুষ, সে নিষেধ শোনে। আর যে নিষেধ শোনে না, সে বুঝে সে কী’
এরপরে মুহতারাম বলেন, ‘অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি, এটা বোঝা দরকার। সকল ধর্মের ঐক্য— অর্থাৎ, মুসলিম দেশগুলোতে অন্যান্য ধর্মের মানুষের বসবাস করার অধিকার রয়েছে। তারা তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পালন করবেন এবং নিজেদের পরিমণ্ডলে থাকবেন। এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়, যার জন্য তারা আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবেন। কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “লা ইকরাহা ফিদ্দীন” অর্থাৎ, ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।’ তিনি আরো বলেন, কাউকে জোরপূর্বক মুসলমান বানানো ইসলামের শিক্ষা নয়। একজন মানুষকে মুখে ইসলাম গ্রহণ করানো যথেষ্ট নয়; সে যদি অন্তর থেকে ইসলাম গ্রহণ না করে, তবে তার ইসলাম গ্রহণের প্রকৃত কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ তায়ালা কাউকে বাধ্য করে মুসলিম বানানোর আদেশ দেননি। বরং তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, ইসলাম গ্রহণ করে শান্তি ও মুক্তির পথ বেছে নিতে।’
এরপরে খতীব সাহেব বলেন, ‘ইসলাম মানুষকে শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকার প্রদান করেছে। যারা মুসলিম নয়, কিন্তু ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র করে না বা অন্যের ওপর জুলুম করে না, তাদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ইসলাম তাদের ধর্মকে অনুমোদন দিয়েছে। ইসলাম স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্ম বাতিল এবং মিথ্যা।’ এবিষয়ে খতীব সাহেব আরো বলেন: “আল্লাহ তাআলা অন্য ধর্মগুলোকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেননি। তিনি বলেছেন, ইসলাম গ্রহণ করো এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়ত মোতাবেক জীবনযাপন করো। যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না, তাদের হিসাব আখিরাতে হবে। তবে তারা যদি সমাজে শান্তি বজায় রাখে, তাহলে তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।”
এরপরে মুহতারাম বলেন, ‘আন্তঃধর্মীয় ঐক্য মানে এই নয় যে, সব ধর্ম সঠিক। বরং এটা বোঝায়, কেউ কারো ওপর জুলুম করবে না এবং শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”—এই ধারণা ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেননা, মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী চলে এবং অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা তাদের জন্য বৈধ নয়।’
এরপরে সম্মানিত খতীব সাহেব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘শান্তি ও নিরাপত্তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই আসতে পারে। আল্লাহ তায়ালার নামগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘আস-সালাম’ (শান্তির মালিক) এবং আরেকটি হলো ‘আল-মুমিন’ (নিরাপত্তা দাতা)। যদি মানুষ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে, তাহলেই আল্লাহ তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দান করবেন।’
এরপরে মুহতারাম বলেন, ‘ইসলামের আকিদা ও বিশ্বাসগুলোর প্রতি দৃঢ় থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো বিভ্রান্তি তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। ইসলাম মানুষকে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়, তবে এটা কখনোই ভুল ধর্মগুলোকে সত্য বা গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক বুঝ এবং ইসলামের পথে চলার তৌফিক দিন। আমাদের দেশ ও সমাজে শান্তি বজায় রাখুন। আমীন।’
এরপরে জুমার বয়ানে খতীব মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিযাহুল্লাহ শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জনে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যদি আমরা শান্তি এবং নিরাপত্তা চাই, তাহলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে হবে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত হবে ইবাদত করার মাধ্যমে, আর ইবাদত করা আল্লাহ তায়ালা ফরজ করেছেন। সেজন্য উচিত আল্লাহ যা ফরজ করেছেন সে ইবাদতগুলো আদায় করা এবং আল্লাহ তায়ালা যা হারাম করেছেন সেগুলো থেকে বিরত থাকা। পাশাপাশি আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা।’
‘যদি আল্লাহর জমিনে অন্যদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে হলে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, তাঁর বিধি-বিধান মানতে হবে ও দেশে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর কোনো নাফরমানি বা আল্লাহ তায়ালা যেটাতে অসন্তুষ্ট হন এমন কোনো অন্যায়, অত্যাচার দেশে করতে দেওয়া যাবে না।’
জুলুম নির্যাতন সম্পর্কে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় হারাম কাজগুলোর মধ্যে হচ্ছে জুলুম-নির্যাতন। জুলুম হলো মহাপাপ—কবিরাগুনাহ। যে সমাজে জুলুম আছে, অত্যাচার আছে, সেটা কখনো ভালো সমাজ হতে পারবে না। যারাই জুলুম করুক, ছোট থেকে বড় পর্যন্ত সকল স্তরের মধ্যে যে ব্যক্তি জুলুম করবে, তারাই সমাজকে নষ্ট করে। যে সমাজে জুলুম আছে, সে সমাজে কখনো শান্তি আসতে পারবে না। শান্তি ও নিরাপত্তা সমাজে আসতে হলে সে সমাজে আমানত ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর আমান ও নিরাপত্তা থাকতে হলে ঈমান থাকতে হবে। তাই আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে হবে ঈমানের মাধ্যমে। আর তাই সকল নির্যাতন থেকে, শুধু শিশু নির্যাতন অথবা নারী নির্যাতন নয়, বরং সকল প্রকার নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকতে হবে। বিশেষ করে যারা বেশি দুর্বল, তাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন আল্লাহ তায়ালারকাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় এবং তা আল্লাহ তায়ালার ক্রোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আর তখন আল্লাহ তায়ালা শান্তি ও নিরাপত্তা উঠিয়ে নেন।’
এরপরে স্ত্রীদের মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে খতীব সাহেব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে ও ইন্তেকালের সময় বলেছেন:
فاتقوا الله فى النساء
فإنكم اخذتموهن بأمان الله
واستحللتم فروجهن بكلمه الله
অর্থ: “মহিলাদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর! কেননা আল্লাহ তায়ালার আমানে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহ তায়ালার বিধানের মাধ্যমে তোমরা তাদের লজ্জাস্থানকে হালাল করেছ।”
হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহতারাম বলেন, ‘এখানে বলা হয়েছে, তোমরা মহিলাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো! দ্বিতীয়তে বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহ তায়ালার আমানের মাধ্যমে তাদেরকে গ্রহণ করো। এজন্যই স্ত্রীরা হলেন হালাল, কোনো পরনারী আমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, তবে মাহরাম নারীরা ব্যতীত। তৃতীয়তে বলা হয়েছে, তাদের উপভোগ করা হালাল হয়েছে আল্লাহ তায়ালার বিধান অনুযায়ী। অন্য কোনো নারী তোমাদের জন্য হালাল নয়। নাকি পশ্চিমাদের মতো বলবেন যে, দুজনে মারামারি করলেই একে অপরের জন্য হালাল হয়ে গেল! এটা হলো কুফরি কথা। তাই এরকম বলা কখনো জায়েজ নয়।’
এরপরে সমকামিতা সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়ে সম্মানিত খতীব সাহেব বলেন, ‘নিজের মনে আছে মেয়ে, তাহলে সে মেয়ে হয়ে যাবে; আর নিজের মনে আছে সে পুরুষ, তাহলে সে পুরুষ হয়ে যাবে—এটা কুফরি কথা, ঈমানি কথা নয়। তাই কোনো মেয়ে আরেক মেয়ের জন্য হালাল নয়। আর তাদের মাঝে কোনো প্রকার কামভাবও হতে পারে না। একইভাবে পুরুষের মধ্যেও এই কামভাব হতে পারে না, এটা হারাম।’
‘সমকামিতা হারাম—মেয়েদের মাঝে হোক বা ছেলেদের মাঝে। পুরুষের জন্য শুধু তার স্ত্রী হালাল, অন্য কোনো মেয়ে তার জন্য হালাল নয়। আর পুরুষের জন্য তার স্ত্রী হালাল হয়েছে আল্লাহর হুকুমে, আল্লাহ তায়ালার কালেমার মাধ্যমে।’
এরপরে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল লক্ষ্য নিয়ে খতীব সাহেব বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তোমরা পুরুষও বলেছ, আর তোমার স্ত্রীও বলেছে। এরপর দুজনে আল্লাহ তায়ালার বিধান মেনে ইজাব-কবুলের মাধ্যমে দুজনে অঙ্গীকারবদ্ধ বা ওয়াদাবদ্ধ হয়েছ। তখনই তোমরা দুজনে একে অপরের স্বামী-স্ত্রী। আর এখানে আল্লাহ তায়ালার বিধান মেনেই হালাল হয়েছে, এমনিতেই কোনো মেয়ে কোনো ছেলের জন্য হালাল নয়। তাই এটা মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তায়ালার বিধান মেনেই স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য হালাল হয়েছে, এমনিতেই হালাল হবে না। এটা হলো এক নাম্বার বিষয়। আর দুই নাম্বার হলো: শুধু আল্লাহ তায়ালার বিধানের মাধ্যমেই হালাল হয়নি, বরং এর জন্য আরো কিছু শর্ত রয়েছে। আর তা হলো, শান্তি চুক্তি। এই কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেছেন বি আমানিল্লাহ, অর্থাৎ শান্তি চুক্তির মাধ্যমেই বিয়ে হয়।’
খতীব সাহেব আরো বলেন, ‘যদি কোনো স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া হয়, অত্যাচার করা হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালার সাথে করা শান্তি চুক্তি বিনষ্ট হবে। তাই কোনো স্ত্রীর ওপর জুলুম করা, তার বোনের ওপর জুলুম করা বা তার মায়ের ওপর জুলুম করা আল্লাহ তায়ালার সাথে করা অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করে। তাই আল্লাহ তায়ালার অঙ্গীকার হলো তাদের সাথে সর্বদা সদাচরণ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وعافروهن بالمعروف
অর্থাৎ, “তোমরা তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করো।”
তাই এ কথা বলা যাবে না, “আমার স্ত্রীকে ভালো লাগে না বা আমার বাবা-মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।” পরনারী বা পরপুরুষের দিকে খারাপ নজরে তাকালে নিজের স্ত্রীকে ভালো লাগবে না—এটাই স্বাভাবিক। তাই স্ত্রী ভালো না লাগার মতো কিছু নেই। মন ভালো থাকলে কিছুকেই ভালো লাগানো যায়। যখন আপনি স্ত্রীর সাথে বিধি-বিধান অনুযায়ী হালাল হয়েছেন, ইজাব-কবুল শেষ করেছেন, তখন মনে করবেন আল্লাহ তায়ালা একে একমাত্র আপনার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। মোনাজাতে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করুন, “হে আল্লাহ! আমাকে তার দৃষ্টিতে ভালো বানিয়ে দিন এবং তাকে আমার দৃষ্টিতে ভালো বানিয়ে দিন। আমাকে তার মনে বসিয়ে দিন এবং তাকে আমার মনে বসিয়ে দিন।”
এরপরে এবিষয়ে মুহতারাম আরো বলেন, ‘যদি ভালো না লাগে, তাহলে শুনে রাখুন, তার মধ্যে আল্লাহ তায়ালা এমন অনেক গুণ রেখেছেন, যেগুলোতে আপনার জন্য অনেক কল্যাণ রয়েছে। তাই স্ত্রীকে ভালো না লাগার মতো কোনো যুক্তি নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
فان كرهتموهن فعسى ان تكرهوا شيئا ويجعل الله فيه خيرا كثيرا
অর্থাৎ, “তোমাদের যা ভালো লাগে না, তার মাঝেও আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।”
তাই স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন, সদাচরণ করুন এবং তাকে ভালোবাসুন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে স্ত্রীর প্রতি সদ্ব্যবহার করার তৌফিক দান করুন।’
ওয়া আখিরু দাওয়ানা আনিল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন….