কোপটিক চার্চ মূলত মিশরের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মূলধারার একটি অংশ এবং বিশ্বের প্রাচীনতম খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলোর একটি। এই চার্চের নেতৃত্বে আছেন কোপটিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্ক, যিনি ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মিশরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% কোপটিক খ্রিস্টান, যারা আরব জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের মিশেলে নিজেদের পরিচয় গড়ে তুলেছে।
মুবারক শাসন
হোসনি মুবারক মিশরের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। তার শাসনামলকে চিহ্নিত করা হয় স্থিতিশীলতার আড়ালে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, স্বৈরতন্ত্র, এবং ‘তুলনামূলক শান্তি’ রক্ষার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের সময় হিসেবে। এ সময় চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, যেখানে রাজনৈতিক সুবিধা ও সমঝোতা প্রাধান্য পেয়েছিল।
চার্চের বিবৃতি: দুর্বল প্রতিক্রিয়া
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোপটিক চার্চ একটি বিবৃতি দেয়। তবে বিবৃতিটি কেবল সহিংসতার নিন্দা ও শান্তি স্থাপনের আহ্বানে সীমাবদ্ধ ছিল। মিশরীয় সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করলেও ফিলিস্তিনের প্রতি চার্চের ঐতিহাসিক সমর্থনের তুলনায় এ বিবৃতি খুবই নিষ্প্রভ বলে মনে হয়েছে। এর ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, চার্চ কি তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে?
ইতিহাস: দৃঢ় অবস্থানের ভিত্তি
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোপটিক চার্চ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে। পোপ শেনুদা তৃতীয় নিজে ফিলিস্তিন যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চার্চের ধর্মতত্ত্ব ইসরায়েলের দাবি ও ধর্মীয় ভিত্তির সমালোচনায় জোরালো ভূমিকা পালন করেছে। সেই সময় চার্চ আরব খ্রিস্টানদের বৃহত্তর আরব জাতির অংশ হিসেবে দেখত এবং ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করত।
জায়োনিস্ট খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে আরব খ্রিস্টধর্ম
কোপটিক চার্চ শুধু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি, বরং জায়োনিস্ট খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে আরব খ্রিস্টধর্মের ধারা গড়ে তোলে। জায়োনিস্ট খ্রিস্টধর্ম পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার ধারাকে ধর্মীয়ভাবে সমর্থন করত এবং জেরুজালেমে ইহুদি মন্দির পুনর্নির্মাণের ধারণার সপক্ষে ছিলো। কোপটিক চার্চ এ ধারা প্রত্যাখ্যান করে জেরুজালেমের আরব পরিচয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
রবিবারের স্কুলের প্রজন্ম
পোপ সিরিল ষষ্ঠের সময়ে শুরু হওয়া এবং পোপ শেনুদা তৃতীয়ের নেতৃত্বে আরও শক্তিশালী হওয়া রবিবারের স্কুলের প্রজন্ম কোপটিক চার্চের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রজন্মের নেতা এবং অনুসারীরা কোপটিক চার্চকে শুধু একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং আরব জাতীয়তাবাদ ও খ্রিস্টান আরবদের ঐক্যের একটি প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
তাদের মতে, ফিলিস্তিনি সংকট কেবল একটি আঞ্চলিক বা রাজনৈতিক ইস্যু নয়, বরং এটি পুরো আরব বিশ্বের জাতীয় এবং ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। আরব খ্রিস্টানরা এই সংকটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং তাদের উচিত বৃহত্তর আরব জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
এই প্রজন্ম ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাতীয়তাবাদের শিক্ষা দিয়েছিল, যা কোপটিক চার্চের ঐতিহ্যের সঙ্গে আরব বিশ্বের বৃহত্তর ঐক্যের ধারণাকে একীভূত করেছিল। তাদের প্রচেষ্টার ফলে চার্চ আরব সমাজে একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, যা ফিলিস্তিনি সংকটের মতো বিষয়গুলোতে চার্চের দৃঢ় অবস্থান গড়ে তোলে।
মুবারক শাসনের প্রভাব
মুবারক যুগে কোপটিক চার্চের অবস্থানে একটি বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ সময় চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যাকে বলা হয় ‘তুলনামূলক সুবিধা ও সহযোগিতার যুগ’। চার্চ তাদের নীতি কিছুটা নমনীয় করে, যেমন জেরুজালেম ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে। যদিও পোপ শেনুদা ফিলিস্তিনের পক্ষে তার অবস্থানে অটল ছিলেন, তবে রাজনৈতিক সমঝোতার কারণে চার্চের ঐতিহাসিক দৃঢ়তাকে আংশিকভাবে বিসর্জন দিতে হয়।
বর্তমান অবস্থান
বর্তমানে কোপটিক চার্চের ভূমিকায় একটি স্পষ্ট অবনতি দেখা যাচ্ছে। চার্চের নেতৃত্বে প্রজন্মের পরিবর্তন, ফিলিস্তিনে ইসলামপন্থীদের উত্থান এবং জায়োনিস্ট খ্রিস্টধর্মের প্রসার এই অবস্থার জন্য দায়ী মনে করা হয়। অনেকেই মনে করেন, ফিলিস্তিনি সংকট এখন আর চার্চের অগ্রাধিকারের মধ্যে নেই, যা কোপটিক খ্রিস্টানদের জাতীয় ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
ভবিষ্যৎ: পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা
কোপটিক চার্চ কি তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পুনরুদ্ধার করতে পারবে? চার্চের নেতৃত্ব কি আবার আরব জাত্যাভিমানের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হবে? নাকি বর্তমান বাস্তবতায় তারা কেবল ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই নির্ধারণ করবে কোপটিক চার্চের ভবিষ্যৎ এবং তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা।
সূত্র: আল জাজিরা