একসময় জুঁই ফুলের মিষ্টি সুবাসে ঘেরা একটি দেশ ও ফুলের দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল সিরিয়া। সেখানকার প্রকৃতি ছিল মনোমুগ্ধকর। অর্থনীতি দাঁড়িয়ে ছিল কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের ওপর। কিন্তু যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে দেশটি আজ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত। একসময় যে দেশটি পরিচিত ছিল জুঁইয়ের জন্য, সেই সিরিয়া এখন পরিচিতি পাচ্ছে ক্যাপ্টাগনের সাম্রাজ্য হিসেবে!
ক্যাপ্টাগন
ক্যাপ্টাগন একটি সাদা ট্যাবলেট, যা ফেনিথাইলিন নামক এক ধরনের শক্তিশালী মাদক। এটি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, সাময়িকভাবে শক্তি ও মনোযোগ বাড়ায়। কিন্তু এর অতিরিক্ত সেবন শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে। এই মাদকের উৎপাদন খরচ এক ডলারেরও কম, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম আকাশছোঁয়া। আর এই মাদক তৈরিতেই সিরিয়া এখন হয়ে উঠেছে বিশ্ব মাদক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র।
ক্যাপ্টাগনের সর্বোচ্চ উৎপাদনকেন্দ্র
বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ ক্যাপ্টাগন উৎপাদিত হয় সিরিয়ায়। দেশটির স্বৈর সরকার যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার মুখে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে মাদক উৎপাদন ও বাণিজ্যকে বেছে নিয়েছে। একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, সিরিয়ার মোট জাতীয় আয়ের অর্ধেকের বেশি আসে এই মাদক রপ্তানি থেকে! ২০২১ সালে সিরিয়া এই বাণিজ্য থেকে আয় করেছে প্রায় ৫.৭ বিলিয়ন ডলার। শুধু সরকারি মদদপুষ্ট চক্রগুলোই প্রতিবছর উপার্জন করছে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন ডলার!
মাদক বাণিজ্যের প্রসার
মাদক বাণিজ্যের এই চেইন শুধু সিরিয়ার ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী দেশ জর্ডান, লেবানন, ইরাক এবং বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলোতে। সৌদি আরব এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ভুগছে। ক্যাপ্টাগনের ব্যবহার ও পাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েও দেশটি সফল হতে পারেনি। ২০১৪ সাল থেকে সৌদি আরব প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ক্যাপ্টাগন ট্যাবলেট আটক করেছে। ২০২৩ সালে জেদ্দা বন্দরে ১.২ কোটি ট্যাবলেটের একটি চালান আটক হয়, যা সিরিয়ার মাদক নেটওয়ার্কের ব্যাপ্তি তুলে ধরে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন সিরিয়ার ফ্যাসিস্ট আসাদ সরকারকে সরাসরি এই মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বলে উল্লেখ করেছে। ক্যাপ্টাগন থেকে প্রাপ্ত অর্থ শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে এবং যুদ্ধকালীন খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও সিরিয়া এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, দেশের অর্থনীতি ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
এই মাদক সাম্রাজ্যের প্রভাব শুধু সিরিয়ার ভেতরেই নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপজুড়েই পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সুযোগে এই মাদক বাণিজ্য আরও বিস্তৃত হচ্ছে। মাদক থেকে অর্জিত তাৎক্ষণিক অর্থ হয়তো দেশটিকে কিছুটা আর্থিক স্বস্তি দিচ্ছে, কিন্তু এটি সমাজ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূচনা করছে।
সূত্র: আরাবি ২১, সিএনবিসি