সংবিধান সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধান থেকে ‘জাতির পিতা’ বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে সংবিধানের মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। তাদের মতে, এ বিধানগুলো বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের পথ সুগম করেছে।
গতকাল শনিবার ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়। পাঁচ খণ্ডের এই প্রতিবেদন কমিশনের নিজস্ব ওয়েবসাইট ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
‘জাতির পিতা’ বিধান বাতিলের প্রস্তাব
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে একজন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা ব্যক্তি বন্দনার সংস্কৃতিকে উসকে দেয় এবং স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি করে। বাংলাদেশ বহু মানুষের আত্মত্যাগের ফসল, তাই একক ব্যক্তিকে ‘জাতির পিতা’ আখ্যা দেওয়ার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলে মত দিয়েছে কমিশন।
এছাড়া, সংবিধানে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শনের বাধ্যতামূলক বিধানও বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব
কমিশন দাবি করেছে, ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এটি তৎকালীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ইশতেহার ও খসড়া সংবিধানেও এ ধারণার উল্লেখ ছিল না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী সমাজ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। অতীতে এটি ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের আদর্শিক ভিত্তি’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বহাল রাখার পক্ষে মত
সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখার বিধান বহাল রাখার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের মতে, জনমতের বিশাল অংশ রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে কমিশনের সব সদস্য এতে একমত হননি।
প্রতিবেদনে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অন্তর্ভুক্ত করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত করার প্রস্তাব
কমিশনের মতে, প্রধানমন্ত্রীপদ সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে যে, এটি কার্যত একক স্বৈরশাসনের রূপ নিয়েছে। তাই ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সংবিধানের সংশোধন প্রয়োজন।
এজন্য একজন ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন এবং তার মেয়াদ চার বছর হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পারবেন না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সংবিধানের ৫৫ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীকে অসীম নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছে, যা ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটিয়েছে। ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ দলীয় শৃঙ্খলার নামে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সংকুচিত করেছে। বিচার বিভাগের ওপরও প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, যা সাংবিধানিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে।
অধিকার সুরক্ষায় নতুন সুপারিশ
কমিশন জনগণের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে। তাদের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে—
১. ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা: ন্যায়পাল নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা, জামিনের অধিকার নিশ্চিত করা এবং বেআইনি উপায়ে প্রাপ্ত প্রমাণ বাতিল করা।
২. গোপনীয়তার অধিকার: ব্যক্তি ও জনপরিসরে নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষা নিশ্চিত করা।
৩. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা: আদালতের রায়ের সমালোচনার অধিকার সংবিধানে স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা।
৪. সংগঠনের স্বাধীনতা: ট্রেড ইউনিয়ন ও সমাবেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা।
৫. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ: ভোক্তাদের সুরক্ষায় সংবিধানে বিধান সংযোজন করা।
কমিশনের মতে, এসব সংস্কার দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং রাষ্ট্রক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করবে।
এদিকে কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো কিছু সুপারিশকে স্বাগত জানালেও, ক্ষমতাসীন দল একে বিতর্কিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছে।
সংবিধান সংস্কার নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আরও আলোচনা হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ প্রস্তাব কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।