চারপাশে টিনের ঘর, সরু গলি আর ভিড়ের মধ্যে এক কোণে তৈরী করা হয়েছে একটি ছোট ঘর। ঘর নয়, যেন এক স্বপ্নের পাঠশালা। এখানেই প্রতিদিন বিকেলে রোহিঙ্গা কিশোরীরা জড়ো হয়। কেউ হাতে গ্লাভস পরে, কেউ পা উঁচিয়ে দেয়াল ছোঁয়ার চেষ্টা করে। শিখছেন আত্মরক্ষার কৌশল—শিখছেন ’টায়কোন্ডো’।
সহিংসতা থেকে আত্মরক্ষার পথ
বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বেড়েই চলেছে নারী ও কিশোরীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা। অপহরণ, যৌন নির্যাতন, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা—সবকিছুর মাঝেও একদল কিশোরী এখন আত্মবিশ্বাসী। তাদের হাতে এখন আত্মরক্ষার হাতিয়ার, আত্মমর্যাদার প্রতীক—টায়কোন্ডো।
১৪ বছর বয়সী রোজিনা আক্তার বলে, ‘আমি শিবিরে থাকি, টায়কোন্ডো শিখছি যেন নিজেকে রক্ষা করতে পারি। মাঝে মাঝে অনুশীলনে কষ্ট হয়, কিন্তু আমার কোচ নাসিমা আপু সবসময় পাশে থাকেন।’
নাসিমা—এই নামটিই যেন এখন রোহিঙ্গা কিশোরীদের অনুপ্রেরণার প্রতীক। মাত্র ৪ বছর বয়সে বাবা মোহাম্মদ সেলিমের হাতে টায়কোন্ডো শিখতে শুরু করেন তিনি। আজ তিনি নিজেই একজন প্রশিক্ষক। মেয়েদের শেখাচ্ছেন আত্মরক্ষার কৌশল। শেখাচ্ছেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে।
বাবার হাতে শুরু, মেয়ের হাতে গর্ব
৪৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ সেলিম নিজের মেয়ের প্রশিক্ষক। আর তারও বেশি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। ২১ বছর ধরে টায়কোন্ডোর সঙ্গে যুক্ত এই রোহিঙ্গা কোচ বর্তমানে পরিচালনা করছেন ’রোহিঙ্গা আরাকান টায়কোন্ডো ক্লাব’। তার কথায়, ‘এই খেলাটা মেয়েদের আত্মরক্ষার পাশাপাশি যুব সমাজকে অপরাধ থেকে দূরে রাখে। আমার ক্লাবে যে আসে, সে আর ভুল পথে হাঁটে না।’
বর্তমানে তার ক্লাবে ৩৮ জন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, যার মধ্যে ১৭ জনই মেয়ে। ছোট মেয়ে শমশিদা বিবি, মাত্র ৯ বছর বয়সেই চার মাস ধরে টায়কোন্ডো শিখছে। তার স্বপ্ন, ‘ভবিষ্যতে আমি একজন ভালো কোচ হতে চাই, যাতে পুরো রোহিঙ্গা সমাজকে শেখাতে পারি।’
স্বীকৃতি নেই, তবুও চলছে লড়াই
সবকিছুই যেন ঠিকঠাক চলছে, কিন্তু বড় একটি সমস্যা প্রতিনিয়ত পথ আটকে দেয়। কোচ সেলিম বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী হওয়ায় আমরা প্রশিক্ষণের পর কোনো সনদ দিতে পারি না। আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকরাই একমাত্র আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা স্বীকৃতি দিতে পারেন।’
২০১৯ সাল থেকে তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে ২৬০০ থেকে ২৭০০ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জায়গা ছোট, সহায়তা কম। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় মেয়েদের ফিরিয়ে দিতে হয়। তাই আমরা বাংলাদেশ সরকার, UNHCR ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন করছি—একটা বড় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য আমাদের পাশে দাঁড়ান।’

যুদ্ধের ছাপ, আত্মরক্ষা ছাড়া উপায় নেই
২০১৭ সালে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর গণহত্যা অভিযানে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল, তার ক্ষত এখনও বয়ে বেড়ায় রোহিঙ্গা নারীরা। যৌন সহিংসতা, ঘরছাড়া, নিরাপত্তাহীনতা—সবকিছুর প্রেক্ষাপটেই তারা মনে করে, যদি আগে থেকেই আত্মরক্ষার কৌশল জানা থাকত, তবে নিজেদের বাঁচাতে পারত অনেকেই।নাসিমা বলেন, ‘সব মেয়ের টায়কোন্ডো শেখা দরকার। যদি আমরা আগে শেখার সুযোগ পেতাম, তাহলে হয়তো আরও নিরাপদে পালাতে পারতাম।’
আজ নাসিমা শুধু নিজের নয়, পুরো সমাজের গর্ব। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ইতোমধ্যেই একটি স্বর্ণপদক ও একটি ট্রফি জিতেছে সে। তার ভাষায়, ‘অনেকে বলে, যদি নাসিমা পারে তাহলে আমাদের মেয়েরা কেন পারবে না? ওরাও আমার মতো হোক—সেটাই চাই।’
একটি আত্মবিশ্বাসী প্রজন্মের স্বপ্ন
ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া নিঃস্ব পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়েরা আজ টায়কোন্ডোর মাধ্যমে গড়ে তুলছে একটি আত্মবিশ্বাসী প্রজন্ম। এই খেলা তাদের জন্য কেবল শরীরচর্চা নয়, বরং জীবনের ঢাল—নিরাপত্তা, সম্মান ও সাহসের প্রতীক।√সর্বশেষে এটুকু বলা যায়, টায়কোন্ডো এখন রোহিঙ্গা নারীদের জন্য শুধু একটি খেলা নয়—এটি তাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিরোধ। জীবনের জন্য এক রণকৌশল।
সূত্র: এএনএ
উপমহাদেশ ডেস্ক
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link