ফেব্রুয়ারি ১৯৮২। সিরিয়ার হামা শহর পরিণত হয়েছিল রক্তাক্ত এক জনপদে। স্বৈর শাসক হাফিজ আল আসাদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার সরকার ২৭ দিনব্যাপী সেখানে চালায় এক ভয়াবহ গণহত্যা। রাজনৈতিক বিরোধ এবং ক্ষমতা সুসংহত করার নামে হাজার হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া এই নৃশংস ঘটনা চিরকাল সিরিয়ার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।
ক্ষমতা দখল ও সংঘাতের সূচনা
১৯৭০ সালে হাফিজ আল আসাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। ১৯৭৩ সালে তিনি একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা তাকে কার্যত একনায়কত্বের পূর্ণ অধিকার দেয়। এই সংবিধানের বিরোধিতা করতে গিয়ে হামা শহরে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। ‘সংবিধানবিরোধী আন্দোলন’ দমন করতে সরকার ব্যাপক ধরপাকড় চালায়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
‘তালিয়াহ আল মুকাতিলাহ’র উত্থান
সরকারি দমন-পীড়নের জেরে হামা শহরে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ‘তালিয়াহ আল মুকাতিলাহ’ নামের এই সংগঠনটি মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থনে পরিচালিত হয়। তারা সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালাতে শুরু করে।
১৯৭৯ সালের ১৬ই জুন আলেপ্পোর একটি সামরিক স্কুলে তারা একটি বড় আক্রমণ চালায়, যেখানে বহু আলাভি শিয়া সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। এর ফলে সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নেয়।
হত্যা চেষ্টার জেরে গণহত্যার ছাড়পত্র
১৯৮০ সালের ২৬শে জুন হাফিজ আল আসাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এর জন্য সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডকে দায়ী করে। প্রতিশোধ হিসেবে তাদমুর কারাগারে প্রায় ১,০০০ বন্দীকে হত্যা করা হয়। একই বছর মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যপদকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে একটি আইন পাস করা হয়। এই আইন কার্যত বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য আইনি ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৯৮২ সালের হামা গণহত্যা
১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে বিদ্রোহ দমনে সরকার হামা শহরে সামরিক অভিযান চালায়। শহরটি অবরুদ্ধ করে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ এবং পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২রা ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী শহরে প্রথম অভিযান চালায়। সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে তারা। এরপর শুরু হয় বিমান হামলা ও ভারি গোলাবর্ষণ। চতুর্থ দিন ৪ঠা ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় স্থল অভিযান। ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করা হয়। শিশু, নারী এবং পুরুষ কেউই রেহাই পায়নি।
হামা গণহত্যার ফলাফল
এ গণহত্যার ফলে নিহত হওয়া মানুষের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ হাজার বেসামরিক লোক। নিখোঁজ হন ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ। ধ্বংস করা হয় ৭৯টি মসজিদ, ৩টি গির্জা এবং বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও হাসপাতাল। তখন হামা শহরের অবস্থা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বহু মানুষ পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে।
১৯৮২ সালের হামা গণহত্যা ছিল এক সুপরিকল্পিত ও বর্বর ঘটনা। এটি কেবল একটি শহরকে ধ্বংস করেনি, বরং গোটা জাতির ওপর এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। হাফিজ আল আসাদের শাসনামলের এই অধ্যায় সিরিয়ার ইতিহাসে চিরকাল নৃশংসতার প্রতীক হয়ে থাকবে।
সূত্র: আল জাজিরা