অভিযানের সূচনা
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর শনিবার। সেদিন ভোরের আকাশ বেশ শান্তই ছিল। সূর্যের নরম আলোয় সেনাক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ারগুলো বাদামি বর্ণ ধারণ করে ছিল। অন্যসব দিনের মতোই সেদিন বেঘোরে ঘুমুচ্ছিল ইসরায়েল। কিন্তু এই সময় ঘটে যায় বিশের দশকের সবচে’ আলোচিত ঐতিহ্যবাহী ঘটনা।
জল, স্থল এবং আকাশপথে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের সমন্বিত হামলায় কেঁপে ওঠে ইসরায়েল। ইসরায়েলের দুর্ভেদ্য সীমানা পেরিয়ে ইসরায়েলি বসতিগুলোতে প্রবেশ করে প্রতিরোধ বাহিনীর যোদ্ধারা। হামাসের সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেডের চিফ অব স্টাফ মোহাম্মাদ আদ দাইফ এই অভিযানের নাম দেন তুফানুল আকসা। পাশাপাশি এই অভিযানকে গত কয়েক দশকের মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করেন মুহাম্মাদ আদ দাইফ।
আক্রমণের বিস্তারিত
কাসসাম ব্রিগেডের উভচর ইউনিট এবং প্যারাট্রুপার বাহিনীসহ কাসসামের সাধারণ যোদ্ধারা এ দিন সমুদ্র এবং ইসরায়েলি সীমান্ত পেরিয়ে বসতিগুলোতে প্রবেশ করে। অভিযানের বিস্তারিত বর্ননা দিতে গিয়ে কাসসাম ব্রিগেডের চিফ অব স্টাফ মুহাম্মাদ আদ দাইফ গত বছর ৭ই অক্টোবর ভোরে এক অডিও বার্তায় বলেন, ‘আমরা শত্রুর সামরিক স্থাপনা, বিমানবন্দর এবং সেনা ক্যাম্পগুলোর বিরুদ্ধে তুফানুল আকসার সূচনা ঘোষণা করছি।’
তিনি বলেন, ‘আক্রমণের প্রথম ২০ মিনিটে কাসসাম ব্রিগেড ৫ হাজারেরও বেশি রকেট হামলা চালায়। এ সময় মুহাম্মদ আদ দাইফ পশ্চিম তীর এবং ১৯৪৮ এর ভূখণ্ডে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
আক্রমণের কারণ ও প্রতিরোধ বাহিনীর বক্তব্য
ঐতিহাসিক এই হামলা সম্পর্কে হামাসের রাজনৈতিক শাখার উপপ্রধান শহিদ সালেহ আল আরুরি বলেন, ‘গাজার মুক্তিযোদ্ধারা আল আকসা মসজিদের সুরক্ষা এবং বন্দিদের মুক্তির লক্ষ্যে একটি বড় আক্রমণ শুরু করেছে।’ তিনি বলেন, এই আক্রমণ ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিশোধ হিসেবে করা হয়েছে। তিনি পশ্চিম তীরের জনগণকে ইসরায়েলি বসতিগুলোর বিরুদ্ধে সংঘর্ষ শুরু করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পশ্চিম তীর এই যুদ্ধে ‘ফয়সালামূলক ভূমিকা’ পালন করতে সক্ষম হবে।
নিহত ও আহতের সংখ্যা
হামাসের ঐতিহাসিক সেই অভিযানে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শতাধিক ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারী নিহত হয়। বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি সেনাসহ বন্দী কিংবা নিখোঁজ হয় ১০০ জনেরও বেশি। দক্ষিণ ইসরায়েল এবং কেন্দ্রীয় অঞ্চলের স্থানীয় বিমানবন্দরগুলোয় বেসামরিক বিমান উড়া কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তেলআবিবের বেনগুরিয়ন বিমানবন্দরে কয়েক ডজন ফ্লাইট বাতিল করা হয়।
এই অভিযান সম্পর্কে ইসরায়েলি সম্প্রচার সংস্থা জানায়, ৭ই অক্টোবর এবং তার পরবর্তী প্রথম দুই মাসে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষে ৫ হাজার ৩৩৮ ইসরায়েলি নিহত হয়। আহত হয় ৫ হাজার।
কাসসাম ব্রিগেডের সামরিক মুখপাত্র আবু উবাইদা জানান, কাসসাম ব্রিগেড ২০০ থেকে ২৫০ জন ইসরায়েলিকে বন্দী করতে সক্ষম হয়। এদের মধ্যে আবার ৫০ জন ইসরায়েলি নিজ দেশের বোমা হামলায় নিহত হয়েছে।
এদিকে ২০২৪ সালের ৩১শে জানুয়ারি টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, ৭ই অক্টোবরের অভিযানে ২২৩ ইসরায়েলি সেনার মৃত্যু হয়।
এছাড়াও কাসসাম ব্রিগেড ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যোগাযোগ বিভাগের একজন কমান্ডার নিহত হওয়ার কথা জানায়। অন্যদিকে জেরুজালেম পোস্ট জানায়, তুফানুল আকসা নামক সেই অভিযানে এখনো প্রায় ৭৫০ ইসরায়েলি নিখোঁজ রয়েছে। এবং ইসরায়েলি পুলিশ কমিশনার নিশ্চিত করে যে, কিছু পুলিশ সদস্যও এখনো নিখোঁজ এবং তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
ইসরায়েলি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, সেদিন প্রতিরোধ বাহিনী সেদেরত শহরের পুলিশ কেন্দ্রের দখল নেয়। এবং গাজার আশেপাশের তিনটি ইসরায়েলি বসতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। এছাড়াও প্রতিরোধ বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। এবং জিকিম, সেদেরত, মেনিফট, কিসুফিম, দেইর আল বালাহ, খান ইউনিস এবং রাফাহসহ অন্যান্য এলাকা থেকেও ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করা হয়।
সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া
অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ইসরায়েলি যানবাহনের দখল এবং সামরিক ঘাঁটির উপর বিজয় উদযাপন করার ভিডিও, ছবি শেয়ার করতে শুরু করেন ফিলিস্তিনিরা।
অপরদিকে ইসরায়েলি বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পশ্চিম তীরের বিভিন্ন ক্রসিং এবং জেরুজালেমের চারপাশের সামরিক চেকপয়েন্টগুলো বন্ধ করে দেয়। সেইসাথে ক্যালান্দিয়া, শুফাত শরণার্থী শিবির এবং বেইত ইক্সার মতো এলাকায় চলাচলে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা আক্রমণ
এই আক্রমণের পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ‘আয়রন সোর্ডস’ নামক একটি সামরিক অভিযান শুরু করে এবং গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। গাজার আশেপাশের ইসরায়েলি বসতিগুলোতে সতর্কতা সাইরেন বাজানো হয় এবং ইসরায়েলি জনগণকে সরে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়। এরপর গাজার বিভিন্ন স্থাপনায় প্রচণ্ড বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল।
একই সময়ে ইসরায়েলি নৌবাহিনী গাজার উত্তর সীমানার কাছে অবস্থিত জিকিম এলাকায় প্রবেশকারী পাঁচজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে বলে দাবী করে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় বহু শিশু ও নারী হতাহত হয়েছে। এছাড়া ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা ও রাস্তায় নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ৮ হাজারেরও বেশি। আহতদের মধ্যে ৭০% নারী ও শিশু। নিহত হয়েছে বহু স্বাস্থ্যকর্মী। গাজার স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উপর হামলার কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ২৬টি হাসপাতাল এবং ৪৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় ৫৬টি অ্যাম্বুলেন্স।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা গাজার মোট জনসংখ্যার ৮০% এরও বেশি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
ঘটনার পরপরই আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়। এছাড়া লেবাননের হিজবুল্লাহও এই সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করে এবং ইসরায়েলি অবস্থানে হামলা চালায়। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননের বেশ কিছু লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়।
৭ই অক্টোবর তুফানুল আকসা পরপরই গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে অসহায় অবস্থায় পড়ে যায় বেসামরিক জনগন। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে গাজায় প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। ফিলিস্তিনের জনগণের উপর এই অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রেক্ষিতে আগামী দিনে এই অঞ্চলে আরো সংঘর্ষ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র: আল জাজিরা