শহিদ সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ একজন মিসরীয় প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ ও জাগরণের নেতা। গত শতাব্দীতে তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হলেও বিংশ-শতাব্দীতে এসেও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব ও বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া তাঁকে ইসলামি পুনর্জাগরণের অগ্রপথিক ও বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনের একজন তাত্ত্বিক রাহবার মনে করা হয়।
জন্ম ও শিক্ষাদীক্ষা
সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ ১৯০৬ সালের ৯ই অক্টোবর মিশরের উসিউর জেলার মুশা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি পবিত্র কুরআন হিফজ করেন এবং ১৯ বছর বয়সে জামিআতুল আজহারে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষা শেষ করেন। এরপর তিনি ১৯২৮ সালে কায়রোর বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে সাহিত্য ও শিক্ষার উপর স্নাতক অর্জন করেন। আর ঐ বছরই তিনি দারুল উলুমের প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এর মধ্যেই তিনি মিশরের শিক্ষা মন্ত্রণায়ে কাজ করার সুযোগ পান, যে দায়িত্বে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছিলেন।
তিনি ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সেক্যুলার ওয়াফদ পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই দলের সাথে সময় কাটানোর পর তিনি প্রচলিত সেক্যুলার রাজনীতির বিষয়ে ধারণা লাভ করেন এবং এগুলো থেকে তাঁর মোহমুক্তিও ঘটে। আর এরপরই শুরু হয় ইসলামি আঙিনায় তাঁর নতুন পথচলা এবং দাওয়ার উপর তাঁর গবেষণা।
এ সময় তাঁর লিখনীতে প্রাধান্য পায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জাগরণের স্বপ্ন। যেসব লিখনীর মাধ্যমে তিনি কুরআনের আলোকে কথিত আধুনিক সভ্যতার নোংরামি তুলে ধরেন। প্রচার করেন ইসলামি সমাজ ও জীবনব্যবস্থার গুরুত্ব ও আবশ্যকীয়তা। আর এ কারণেই ১৯৪৯ সালে প্রশিক্ষণ সফরের নামে তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একই সাথে তৎকালীন মিশরের উত্তপ্ত রাজনীতি থেকেও তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এ সময়কালে সাইয়্যেদ কুতুব পশ্চিমা ও সেক্যুলার জীবনধারা, বর্ণবাদ ও কথিত আধুনিক সভ্যতাকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। এটি তাঁর সামনে বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলে।
এরপর ১৯৫০ সালে সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ দেশে ফিরে এসে যখন দেখলেন, এই শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি মন্ত্রণায়ের উক্ত পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
কিছুদিন পরেই তিনি তৎকালীন অগণতান্ত্রিক ইসলামি দল ইখওয়ানুল মুসলিমিনে যোগদান করেন। এ সময় তাকে বৃহৎ এই ইসলামি আন্দোলনটির দাওয়াহ ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান করা হয়। আর যোগ্যতার ফলে তিনি হয়ে উঠেন দলের উচ্চপদস্থ ও অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ নেতা। এই সময়ে ক্রমাগত ইখওয়ানের সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন থেকে তিনি তাঁর চিন্তাধারা প্রকাশ করার চেষ্টা করছিলেন।
কারাগারে সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ
১৯৫৪ সালের ২৬শে অক্টোবর আলেকজান্দ্রিয়ার মানশিয়া নামক এলাকায় বক্তব্য প্রদান কালে জামাল আব্দুন নাসেরের উপর আক্রমণের চেষ্টা করা হয়। এই ব্যর্থ আক্রমণের দায়ভার চাপানো হয় ইখওয়ানুল মুসলিমিনের ওপর। এবং এই হত্যাচেষ্টার অজুহাত দেখিয়ে মিশরে ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই অযুহাতে বন্দী করা হয় সাইয়্যেদ কুতুবসহ ইখওয়ানের অনেক নেতা এবং অসংখ্য সাধারণ কর্মীকে।
কারাগারে ভয়াবহ নির্যাতন তখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠে। সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ সময় সরকার প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া ও নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করার শর্তে তাকে মুক্তির প্রস্তাব দেয়।কিন্তু তিনি এ ধরনের সকল প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন। অপমানজনক শর্ত মেনে মুক্তিলাভের বিপরীতে তিনি বন্দীত্বই বেছে নেন। এই দীর্ঘ বন্দীত্বের সময়টাতেই তিনি একে একে তাঁর ঐতিহাসিক রচনাগুলো লিখতে থাকেন। যেগুলোর কারণে পুরো আরব বিশ্বে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
দশ বছর কারাগারে থাকার পর ১৯৬৪ সালে তাঁর স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি ঘটলে তৎকালীন ইরাকি রাষ্ট্রপতি আরিফ আবদুস সালামের অনুরোধে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তাঁকে বাধ্যতামূলক নিজ বাড়িতে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়। আর এ সময় তিনি লিখেন তাঁর যুগান্তকারী রচনা ‘মাআলিম ফিত তারিখ’।
অবিস্মরণীয় বিদায়
১৯৬৫ সালে সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহর বিরুদ্ধে সরকার পতনের চক্রান্তের অভিযোগ এনে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। তখন প্রমাণ হিসেব উপস্থাপন করা হয় ‘মাআলিম ফিত তারিখ’ বা ‘সাইনস অন দ্য রোড’ বইটিকে। পরবর্তী সময়ে ইখওয়ানও এই বইয়ের দায় থেকে নিজেদের মুক্ত ঘোষণা করে।
এ সময় সাইয়্যেদ কুতুবের বয়স ছিলো ৬০ বছর। সেই সাথে বেশ কয়েকটি রোগেও আক্রান্ত হন তিনি। তা সত্ত্বেও মিশরীয় কারাগারে তাঁর উপর নির্যাতন অব্যাহত রাখা হয়। শাসকগোষ্ঠী শুধু তাঁর উপর শারীরিক নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করতে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের উপরও নির্যাতন চালাতে থাকে।
অবশেষে দেশটির সামরিক আদালত সাইয়্যেদ কুতুবের রাহিমাহুল্লাহকে ফাঁসির আদেশ দেয়। তাঁর মুক্তির জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও আলেমগণ তখন সরকারের কাছে আবেদন জানায়। সরকারের সাথে আপস করার শর্তে তাকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ তাঁর আদর্শ ও অবস্থান থেকে বিন্দু পরিমাণ সরে আসতে অস্বীকৃতি জানান।
তখন সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহর স্পষ্ট উত্তর ছিল, ‘যদি আমি মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য হই, তবে আদালতের আদেশের উপর আপত্তি করা অন্যায়। আমি যদি মিথ্যা ও জুলুমের শিকার হই, তবে আমি মিথ্যার কাছে করুণা চাওয়ার পর্যায়ে যেতে পারি না।’ সবশেষ ১৯৬৬ সালের ২৯শে আগস্ট ফজরের সময় সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মৃত্যুদন্ড কার্য করার আগে তিনি বলেছেন, ‘রক্তে সিঞ্চিত না হলে কোনো চেতনার স্থায়িত্ব আসে না।’ এবং তিনি যেন তাঁর জীবন দিয়ে তাই প্রমাণ করে গেছেন। সামরিক শাসন তাঁকে ফাঁসি দিয়ে দেহ বিদায় করেছে ঠিকই, কিন্তু হাজার বছরের জন্য রেখে যাওয়া চেতনার বিদায় করতে পারেনি।
সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহর মৃত্যুদণ্ডের ঠিক আগে আগে একটি ঘটনা ঘটে। যে ঘটনাটি যুগে যুগে মানুষের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে, যে ঘটনা নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন অনেক কবি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে তাঁকে কালিমা পড়াতে একজন শায়েখ পাঠানো হয় জেলখানায়। তখন সাইয়্যেদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহ তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘অবশেষে আপনি এলেন এই নাটকের অবসান ঘটাতে? মনে রাখবেন, আমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর কালিমাকে বিজয়ী করতে চাচ্ছি বলে আমাদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে! আর আপনারা এই কালিমা বিক্রি করে খাচ্ছেন! শুনে নিন, আমি বলছি, আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ!’