আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাজিআল্লাহু আনহু। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন প্রিয় সাহাবি। একাধারে তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিত সৈনিক, মহান কবি এবং আল্লাহর পথে আত্মোৎসর্গকারী একজন মহান শহিদ।
ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আল্লাহর পথে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। বদর, ওহুদ, খন্দকসহ প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে থেকে তিনি ঈমানের দৃঢ়তা ও সাহসিকতার এক প্রেরণাময় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
প্রাথমিক জীবন এবং ইসলাম গ্রহণ
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাজিআল্লাহু আনহু ছিলেন মদিনার আনসার গোত্র খাজরাজের অন্তর্ভুক্ত। মদিনার এক অভিজাত পরিবারে জন্ম তার। আরবের রীতি অনুযায়ী তাঁর উপনাম আবু আমর হলেও, অনেকেই তাঁকে আবু মুহাম্মাদ নামে সম্বোধন করত। ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠ সাহাবি হয়ে ওঠেন এবং দীনের পথে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
সাহসিকতা ও যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাজিআল্লাহু আনহু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এক অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেন। সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার সংগ্রামের সূচনা হয় দ্বিতীয় ‘আকাবা’ চুক্তিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ওই চুক্তিতে ৭০ জন আনসার সাহাবি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই অঙ্গীকারই তাকে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ‘বদরে’ অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা যোগায়। যেখানে তিনি পূর্ণ সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঈমানি শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
এরপর তিনি ওহুদের যুদ্ধেও অংশ নেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই যুদ্ধে তাঁকে এক হাজার পাঁচশ’ সাহাবির নেতৃত্ব প্রদান করেন। আর এভাবে একের পর এক যুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে থেকে দীনের প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবং সাহসিকতার এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
তিনি ছিলেন দীনের মহান কবি
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাজিআল্লাহু আনহুর আরেকটি বৈশিষ্ট হল, তিনি ছিলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে দীন প্রচারের পাশাপাশি ইসলামের শত্রুদের মিথ্যাচারের মোকাবেলা করতেন। তাঁর কবিতায় ছিল নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার শব্দমালা। এবং ইসলামের প্রতি আত্মোৎসর্গের নতুন প্রেরণা। তাঁর কবিতাগুলো শুধু যোদ্ধাদের মনোবলই বাড়াত না। বরং তাঁর কবিতা শত্রুর জন্য ছিল এক ভয়ানক তীরের মতো।
মুতার যুদ্ধে শহিদ হওয়া
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার রাজিআল্লাহু আনহু জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ‘মুতা’ যুদ্ধ। সে যুদ্ধে রোমান সাম্রাজ্যের বিপুল বাহিনীর সামনে মুসলিম বাহিনী সংখ্যা ও শক্তিতে ছিল অপ্রতুল। কিন্তু তিনি ছিলেন দীনের পথে প্রাণ উৎসর্গ করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী। যুদ্ধের প্রাক্কালে সাহাবা কেরাম যখন শত্রুর বিপুল সংখ্যা দেখে একটু থমকে গিয়েছিলেন, তখন আবদুল্লাহ তাঁদের অনুপ্রাণিত করে বলেন, ‘আমরা কখনো সংখ্যার জোরে বা অস্ত্রের শক্তিতে যুদ্ধ করিনি, আমাদের লড়াই শুধু এই দীনের জন্য।’
এরপর যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাজিআল্লাহু আনহু। শাহাদাতের পূর্বে তিনি নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বইলেন, ‘হে মন! তুমি যদি লড়াইয়ে নাও যাও, তবুও মৃত্যু অবধারিত।’ আর এভাবেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি শহিদ হন এবং জান্নাতে প্রবেশ করেন।
অবদান ও প্রভাব
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাজিআল্লাহু আনহু শুধু এক মহান যোদ্ধা বা কবিই নন, তিনি ইসলামের এক অনুপ্রেরণাময় আদর্শ। তাঁর জীবন এবং সংগ্রাম প্রমাণ করে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে সংগ্রাম এবং আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাসই প্রকৃত সফলতার চাবিকাঠি। কীভাবে ইসলামের পথে আত্মত্যাগ এবং নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়, তাঁর অনুপ্রেরণাময় জীবন আমাদের সেই শিক্ষা দেয়।
এছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার রাজিআল্লাহু আনহুর জীবনী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দীনের প্রতি ভালবাসা এবং দীনের জন্য আত্মোৎসর্গ হওয়াই প্রকৃত মুমিনের পরিচয়।