ঘড়িতে সময় ১২:৩৪। সম্মানিত খতিব মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ জাতীয় মসজিদের মিম্বারে আরোহণ করলেন। প্রথমেই সবাইকে সালাম পেশ করলেন৷ এরপর হামদ ও সানা পাঠ করলেন৷ শেষে সুরা হাশরে তাকওয়া সংশ্লিষ্ট আয়াত পাঠ করলেন—
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرٌۢ بِمَا تَعْمَلُونَ
আলোচনার শুরুতে মুহতারাম বলেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে ছোট–বড় অনেক নেয়ামত দান করেছেন। মানুষ সবসময় আল্লাহর নেয়ামতের মধ্যে ডুবে থাকে। আল্লাহর নেয়ামত গুনে শেষ করা যাবে না। আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামত তার মধ্যে একটি মৌসুম।
শীতকাল আল্লাহর নেয়ামত
এখন শীতের মৌসুম। শীতকাল আল্লাহর একটা নেয়ামত। শীতের তীব্রতা, কঠিন শীত, শীতের কারণে মানুষ মরে যায়—সেই শীতটা তো একটা পরীক্ষা। কিন্তু সাধারণ শীত, শীতের মৌসুম এটা একটা নেয়ামত। গরমের তীব্রতা ওটা একটা পরীক্ষা। কিন্তু সাধারণ গরম, গরমকাল সেটাও একটা নিয়ামত। হাদীস শরীফে শীতকাল সম্পর্কে বলা হয়েছে—
الشِّتاءُ رَبيعُ المُؤْمِنِ
অর্থ: শীতকাল মুমিনের বসন্ত। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ১১৭৩৪]
ইবাদাতের মুফতে সুযোগ
যুগে যুগে সাহাবায়ে কেরাম এবং ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য এসেছে যে, শীতকাল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কুদরতি একটি সুযোগ। রাত লম্বা। এশার পরে কেউ অহেতুক সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে পড়লে সুবহে সাদিকের অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠতে পারে। আর অনায়াসেই তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারে। আবার দিন ছোট নফল রোজাও রাখা যায় খুব সহজেই। তাই কোন কোন সাহাবী বলেছেন এটা মুফতে সুযোগ!
আমরা এই সুযোগ কাজে লাগালে যে যেমন পারি দু’চার রাকাত নামাজ পড়ে ফেলতে পারি। যেমন এখন সুবহে সাদিক হয় পাঁচটা আট নয়ে; তো কেউ পৌনে পাঁচটায় উঠলেও যথেষ্ট। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারবে। চারটা সাড়ে চারটায় উঠলে তো কোন কথাই নেই! তাহাজ্জুদের পরে কুরআন তেলাওয়াতও করা যাবে!’
কিয়ামুল লাইল
এরপর মুহতারাম কিয়ামুল লাইল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘কিয়ামুল লাইল মানে রাতের নামাজ; রাত তো সেই মাগরিব থেকেই শুরু হয়েছে, রাতে যদি কেউ অন্য নামাজও পড়ে সেটাও কিয়ামুল লাইলের অন্তর্ভুক্ত। কিয়ামুল লাইল বা রাতে নামাজ পড়া নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করা অনেক বড় নেক আমল। কিয়ামুল লাইলের মধ্যে তাহাজ্জুদের অংশে দু’চার রাকাত নফল আদায় করা আরো বেশি ফজিলতপূর্ণ।’
এরপর বিতর নামাজ আদায় করার উত্তম পদ্ধতি নিয়ে মুহতারাম বলেন, ‘বিতরের নামাজ আমরা সব সময় আগে পড়ে ফেলি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কারো যদি শেষ রাতে ওঠার নিশ্চয়তা থাকে, তার জন্য বিতর শেষ রাতে পড়া ভালো। অর্থাৎ তাহাজ্জুদের পরে পড়বে। আর যদি উঠতে না পারে বিতর কাজা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে শোয়ার আগেই পড়ে নিবে। যদি আমরা শোয়ার আগে বিতর পড়ি তাহলে বিতরের আগে দুই রাকাত বা চার রাকাত নফল পড়া উত্তম।
বিতরের পর দুই রাকাত বা চার রাকাত নফল পড়া—এটার চেয়ে এশার নামাজের ফরজের পর দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা পড়ে দুই রাকাত বা চার রাকাত নফল পড়ে, পরে বিতর পড়া উত্তম। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেউ যদি ঘুমানোর আগে বিতর পড়ে তাহলে যেন এভাবে পড়ে— ركعتان وثلاث، اربع ركعات وثلاث—দুই রাকাত নফল, তিন রাকাত বিতর অথবা চার রাকাত নফল, তিন রাকাত বিতের। এভাবেই বিতর নামাজ আদায় করা উত্তম পদ্ধতি।’
বিতরের পূর্বে নফল নামাজ
তিনি আরো বলেন, ‘কেউ যদি শুধু বিতর নামাজ পড়ে চলে যায় তাহলেও হয়ে যাবে। তবে বিতরের আগে দুই বা চার রাকাত নফল নামাজ পড়া উত্তম; যেমনিভাবে ফজরের নামাজের পূর্বে দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যোহরের নামাজের পূর্বে চার রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা এবং আসরের নামাজের পূর্বে চার রাকাত সুন্নত এবং এশার নামাজের পূর্বে চার রাকাত সুন্নত পড়া উত্তম; তেমনিভাবে বিতেরের পূর্বে দুই বা চার রাকাত নফল পড়া উত্তম। আর যদি শেষ রাতে ওঠার অভ্যাস থাকে তাহলে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে বিতের নামাজ পড়বে এটা সবচেয়ে উত্তম। যাদের তাহাজ্জুদ নামাজের অভ্যাস নাই এখন খুব সুযোগ এখন শীতকাল রাত বড় এখন চাইলে তাহাজ্জুদের অভ্যাস করে নেওয়া যাবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন।’
ঘুমের দোয়া
এরপরে ঘুমের পূর্বের এবং পরে দোয়া পাঠের গুরুত্ব নিয়ে মুহতারাম বলেন, ‘শেষ রাতের সময়টা দোয়া কবুলের সময়, এমনিতেই ঘুম ভাঙ্গার পরে দোয়ার কথা হাদিসে আছে, দোয়া তো সবসময় পড়তে হয়, ঘুমের আগেও দোয়া আছে:
- اللهم باسمك اموت وأحيا
- باسمك ربي وضعت جنبي وبك ارفعه ان امست نفسي فارحمها وان احبست فاحفظها بما تحفظ به عبادك الصالحين
এগুলো ঘুমানোর আগে দোয়া। আরও দোয়া আছে—
- اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَرَبَّ الْأَرْضِ، وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ، فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى، وَمُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْفُرْقَانِ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ شَيْءٍ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ، اللَّهُمَّ أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ
মুহতারাম দোয়াগুলো পাঠ করে বলেন, ‘ঘুমানোর আগে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে ঘুমান, ফলে কোন কিছু আপনাকে ক্ষতি করতে পারবে না।’
সম্মানিত খতিব সাহেব বলেন, ‘আমরা ঘুমের শুরুতে সংক্ষিপ্ত এই দোয়াটি পড়বো—
اللهم باسمك اموت وأحيا
অর্থাৎ, হে আল্লাহ, আমি আপনার নামে ঘুমাচ্ছি এবং আপনার নামেই জাগ্রত হব। এখানে ঘুমকে একটি ক্ষণস্থায়ী মৃত্যু বলা হয়েছে। শব্দটি أموت ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ ‘মৃত্যুবরণ’। অর্থাৎ আমি আপনার নামে ঘুমাচ্ছি এবং আপনার নামেই পুনরুত্থিত হব। এই সংক্ষিপ্ত দোয়ার মধ্যেই একটি পূর্ণ ভাব প্রকাশিত হয়েছে:
اللهم انت الاول فليس قبلك شيء
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আপনি প্রথম। আপনি সব সময় ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আপনার আগে কেউ ছিল না এবং পরেও কেউ থাকবে না। কারণ সমস্ত কিছুই আপনি সৃষ্টি করেছেন। আপনার হুকুমেই সবকিছুর শুরু এবং আপনার হুকুমেই সবকিছুর শেষ হবে।’
খতিব সাহেব আরো বলেন, ‘আল্লাহর অস্তিত্ব এমন যে, তাঁর কোনো শুরু বা শেষ নেই। এই দোয়া আমাদের এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়—
اللَّهُمَّ أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আপনি প্রথম, আপনার আগে কিছুই নেই। আপনি শেষ, আপনার পরে কিছুই নেই। আপনি প্রকাশ্য, আপনার ওপরে কিছুই নেই। আপনি অদৃশ্য, আপনার নিচেও কিছু নেই।’
এরপর মুহতারাম বলেন, ‘আল্লাহর উপর বা নিচের ব্যাপারে সৃষ্টির মতো কোন সীমাবদ্ধতা নেই। যেমন, একটি দোতলা ভবনের নিচে মানুষ থাকে আর ওপরে ভবন থাকে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এরকম সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং মালিক।
দোয়ার আরেকটি অংশ হল—
اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ
অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের ঋণমুক্ত করুন এবং অভাব-অনটন দূর করুন।’
এরপর ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার আরো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দোয়া দরূদ পাঠের বিষয়ে খতিব সাহেব আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘রাতে ঘুম ভেঙে গেলে এই জিকরগুলো পড়ুন—
- لا اله الا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير
- سبحان الله الحمد لله ولا اله الا الله الله اكبر
- ولا حول ولا قوه الا بالله
এরপর এই দোয়া পড়ুন—
ربي اغفر لي
অর্থাৎ, হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা করুন।’
সম্মানিত খতিব সাহেব আরো বলেন, ‘যদি অজু করে নামাজ পড়েন, তবে আল্লাহ তা কবুল করবেন। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দুই-চার রাকাত নফল নামাজ পড়ুন। যদি শেষ রাতে উঠতে না পারেন, তবে অন্তত বিতরের আগে কিছু নফল নামাজ আদায় করুন। তিরমিজি শরিফের একটি হাদিসে এসেছে, যদি কেউ দশবার সুবহানাল্লাহ, দশবার আলহামদুলিল্লাহ এবং দশবার আল্লাহু আকবার পড়ে, তবে আল্লাহ তায়ালা বলবেন- اسال ما شئت -অর্থাৎ, তুমি যা চাইবে, তা তোমাকে প্রদান করা হবে।’
দোয়া কবুল বিষয়ে আলোচনা
এরপরে দোয়া কবুলের বিষয়ে খতিব সাহেব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন—
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِى عَنِّى فَإِنِّى قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا۟ لِى وَلْيُؤْمِنُوا۟ بِى لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
অর্থ: ‘আমার বান্দারা যখন আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে, বলে দাও আমি তাদের নিকটবর্তী। যে আমার কাছে দোয়া করবে, আমি তার দোয়া কবুল করব।’ [সুরা বাকারাহ: ১৮৬]
একবার জিজ্ঞেস করা হলো নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর কাছে আমরা যে প্রার্থনা করি দোয়া করি, সে দোয়া কি ধীরে ধীরে করব নাকি ছোট আওয়াজে করব না উঁচু আওয়াজে করব?
اقريب ربنا ام بعيد؟ اقريب فنناديه ام بعيد فنناديه؟
তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে—
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِى عَنِّى فَإِنِّى قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا۟ لِى وَلْيُؤْمِنُوا۟ بِى لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—
وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدْعُونِىٓ أَسْتَجِبْ لَكُمْۚ
অর্থ: ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ [সুরা গাফির: ৬০] তাই যেকোন সময় আল্লাহকে স্মরণ করুন এবং দোয়া করুন।
দোয়া করার ক্ষেত্র
এরপর দোয়া করার ক্ষেত্র নিয়ে মুহতারাম বলেন, ‘কোন কাফেরের জন্য দোয়া করা যায় না। তাছাড়া কোন খারাপ কাজ বা গুনাহের জন্য দোয়া করা যাবে না। গুনাহের জন্য দোয়া করলে সেই দোয়া কবুল হবে না। তাছাড়া কবুল হোক বা না হোক, এসব কাজের জন্য দোয়া করা যাবে না। কারণ, হাদিস শরিফে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম, তাই এ বিষয়ে দোয়া করা যাবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভালো কোন কিছুর জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করলে তিনি তা কবুল করেন। পাশাপাশি দোয়া কবুলের সময়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন, শেষ রাত, মধ্যরাত এবং নামাজের পরে।’
ফরজের পর সম্মিলিত দোয়া শরিয়তসম্মত পদ্ধতি নয়
এরপরে মুহতারাম আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ নামাজের পরে সম্মিলিত মােনাজাত নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘নামাজের পর সকলে মিলে একসাথে হাত তুলে যে মোনাজাত করা হয়, সেটাও মোনাজাতেরই একটি প্রকার। তবে ফরজ নামাজের পর সকলে মিলে একসাথে সম্মিলিতভাবে দোয়া করা কোন শরিয়তসম্মত পদ্ধতি নয়।
আমরা যে জুমার নামাজ পড়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করি, তাতে নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। কেউ যদি দোয়া শুরুর পর ব্যক্তিগত দোয়া-দুরুদ শেষ করে মোনাজাতে শরিক হন বা ইমাম সাহেব দোয়া শেষ করার পরে নিজের মতো করে দোয়া করেন, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। এমনকি কেউ যদি জুমার নামাজের পরে আযকার বা দোয়া-দুরুদ পড়ে মোনাজাত না করেন, তাতেও কোন সমস্যা নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘তবে মনে রাখতে হবে, এটি (নামাজের পরের সময়) দোয়া কবুলের সময়। কখনো দেখা যাবে, ইমাম তাসবিহ-তাহলিল বা আযকার পড়ছেন, হাত তুলছেন না, বা সরাসরি সুন্নতে দাঁড়িয়ে গেছেন। তখন তার জন্য অপেক্ষা না করে নিজের মতো করে মোনাজাত করতে হবে। কারণ, একসাথে মোনাজাত করা নিয়মিত কোন সুন্নত নয়। এটি মাঝে মাঝে হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।’
এরপর মুহতারাম বলেন, ‘সবকিছু ফরজ নামাজের মতো নয়। বিষয়গুলো মানুষকে বুঝতে হবে। ফরজ নামাজ সালাম ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। ইমাম ও মুক্তাদির জন্য নামাজ সালামের মাধ্যমে শেষ হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
تحليلها التكبير وتحريمها التسليم
অর্থাৎ, নামাজের শুরু হয় তাকবির দ্বারা এবং শেষ হয় সালাম দ্বারা। সালাম ফেরানোর পর নামাজ শেষ হয়ে যায়। তখন আর ইমাম ইমামতি করেন না। মোনাজাতের মধ্যে কোনো ইমামতি নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘তবে দোয়া একটি বড় ইবাদত। হাদিস শরিফে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الدعاء هو العبادة
অর্থাৎ, দোয়া হলো এক মস্ত বড় ইবাদত।
দোয়া মানে মন খুলে আল্লাহ তাআলার কাছে চাওয়া। আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক দোয়ার তুলনায় এটি ব্যক্তিগতভাবে করা উত্তম। দোয়া এমনভাবে করতে হবে, যেন তা হৃদয় থেকে বের হয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছায়। কারণ, একমাত্র আল্লাহই দান করতে পারেন।
ফরজ নামাজের পরে দোয়া
প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর এই দোয়া পড়া উচিত—
اللهم لا إله إلا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير. اللهم لا مانع لما أعطيت ولا معطي لما منعت. اللهم لا ينفعك الجد منك الجد.
দোয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তাআলার কাছে নিজেকে সোপর্দ করা এবং বারবার নিজের প্রয়োজন বলার মাধ্যমে তা চেয়ে নেওয়া।
আমরা দোয়া করব নিজের জন্য, মুসলিম উম্মাহর জন্য এবং দেশের জন্য। আমাদের দেশ তাওহিদের জমিন, এ দেশের ওপর আমাদের হক রয়েছে। তাই দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং কল্যাণের জন্য দোয়া করতে হবে।’
দেশে অস্থিতিশীলতা
এরপরে মুহতারাম দেশের অস্থিতিশীলতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের জন্য হেদায়েত প্রার্থনা করতে হবে। দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা কবিরা গুনাহ। যারাই দেশের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করে, মুসলিম উম্মতের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করে, তারাই দেশের শত্রু; যেই হোক সে। তাদের এসব কাজে ন্যূনতম কোন সাহায্য সহযোগিতা করা অন্যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَتَعَاوَنُوا۟ عَلَى ٱلْبِرِّ وَٱلتَّقْوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُوا۟ عَلَى ٱلْإِثْمِ وَٱلْعُدْوَٰنِۚ
সাহায্য সহযোগিতার পরিণতি আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে বলে দিয়েছেন। নেক কাজে তাকওয়ার কাজে একে অপরের সাহায্য করো। গুনাহের কাজ, পাপের কাজ এবং জুলুমের কাজ; জুলুম করাও পাপ; কিন্তু এটাকে আল্লাহ তায়ালা আলাদাভাবে উল্লেখ করে দিয়েছেন, যেহেতু এটা বেশি ভয়ংকর। যেকোনো পাপের কাজে, বিশেষ করে জুলুমের কাজে একে অপরের সাহায্য করবে না। জালিমদের ব্যাপারে নমনীয় হওয়া—এটাও জুলুমের শামিল।
জুলুম থেকে বারণ
জালিমকে জুলুম থেকে বিরত রাখতে হবে। এবং যদি প্রমাণিত হয় জুলুম; যার ব্যাপারে প্রমাণিত হবে তাকে জুলুমের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া উপযুক্ত বিচার করা—এটা ফরজ। যদি জালিমের ব্যাপারে কেউ নমনীয় হয় সে আল্লাহর কাছে জালিম হিসেবে আল্লাহর খাতায় জালিম হিসেবে লেখা থাকবে। একদিন আগে কিংবা একদিন পরে হলেও এটার শাস্তি ঠিকই পেতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমস্ত মজলুমকে খাস নুসরত দান করেন। আর সব জালিমকে আল্লাহ তায়ালা জুলুম থেকে বিরত রাখেন। তাদের হেদায়েত থাকলে তাদেরকে হেদায়েত দান করেন। হেদায়েত না থাকলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শায়েস্তা করেন।
আপনি যদি চান আপনার দোয়া আপনার জন্য কবুল হোক, তাহলে পুরো উম্মতের জন্য আপনাকে দোয়া করতে হবে। মজলুমদের জন্য দোয়া করবেন। সিরিয়াকে আল্লাহ তালা হেফাজত করেন। ওখানের হালত স্থিতিশীল করে দেন। ওখানে এবং যারা এখন এই দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা শায়েস্তা করেন এবং যাদের দ্বারা এই দেশটা একটা সুন্দর পরিবেশ পাবে, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা শক্তিশালী করেন। ফিলিস্তিনের জন্য তো দোয়া করবেনই; সবার জন্য দোয়া করতে হবে। পুরাে দেশের জন্য, সারা মুসলিম উম্মতের জন্য; যে যেখানেই থাকুক, সবাই كجسد واحد (এক দেহের মতো। অর্থাৎ তারা) এক ও অভিন্ন। সবার জন্য দোয়া করা আমার দায়িত্ব।
অসাধারণ একটি দোয়া
এরপর সম্মানিত খতিব সাহেব হাদিসে রাসুল ﷺ থেকে একটি দোয়া পাঠের শিক্ষা দেন। প্রথমের তিনি সম্পূর্ণ দোয়াটি পাঠ করেন,
اللَّهُمَّ أَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا، وَاهْدِنَا سُبُلَ السَّلَامِ، وَنَجِّنَا مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ، وَجَنِّبْنَا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ، وَبَارِكْ لَنَا فِي أَسْمَاعِنَا، وَأَبْصَارِنَا، وَقُلُوبِنَا، وَأَزْوَاجِنَا، وَذُرِّيَّاتِنَا، وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ، وَاجْعَلْنَا شَاكِرِينَ لِنِعْمِكَ مُثْنِينَ بِهَا عَلَيْكَ، قَابِلِينَ لَهَا، وَأَتِمِمْهَا عَلَيْنَا [أخرجه أبو داود، كتاب الصلاة، باب التشهد، برقم 969]
দোয়া পাঠ শেষ করে মুহতারাম বলেন, এটা পুরাে একটা দোয়া। একটা মোনাজাত। হে আল্লাহ! আমাদের দিলগুলোকে আপনি মিলিয়ে দেন। প্রথম কথা, اللهم الف بين قلوبنا— আমাদের দিলগুলোকে আপনি মিলিয়ে দেন। দিলের মিল না থাকলে যে কী ফিতনা; তা তো দেখতেই পাচ্ছেন আপনারা এই দেশে। দিলের মিল যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে ফেতনা আর ফেতনা। ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
দিলের অমিল
এরপর মুহতারাম বলেন, ‘তো দিল মিলবে কখন? হকের ওপরে এক হয়ে যাও, তাকওয়ার উপর এক হয়ে যাও, তাহলে দিল মিলবে। উলামায়ে কেরামের রাহবারি গ্রহণ করো। উলামায়ে কেরাম বলেছেন, অমুক লোক গোমরাহির কথা বলে, তার অনুসরণ করবে না, তার পিছে হাঁটবে না— উলামায়ে কেরামের এই রাহাবারি যদি গ্রহণ করো তাহলেই তো তোমাদের দিলগুলো মিলবে।’ সম্মানিত খতীব সাহেব পুনরায় পাঠ করেন,
’اللَّهُمَّ أَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا، وَاهْدِنَا سُبُلَ السَّلَامِ
আপনারা এই দোয়া করেন মোনাজাতের মধ্যে। হে আল্লাহ আমাদের দিল গুলোকে মিলিয়ে দেন। আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ঠিক করে দেন।’
কেন এই বিভেদ?
কেন এই বিভেদ— এ বিষয়ে মুহতারাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বলেন, ‘বছরকে বছর কত লোক একসাথে কাজ করেছ, একসাথে ছিলে; এখন কেন এরকম বিভেদ? কেন বিভক্তি? বিভক্তি শুধু এজন্য যে, একজন হকের উপরে থাকতে চায়। আরেকজন থাকতে চায় না। ব্যক্তির পিছনে পড়ে আছে। হকের চেয়ে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। হকের চেয়ে যদি ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেয়া হয় তাহলে ফেতনার হবেই। হককে প্রাধান্য দিতে হবে। ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। তাহলে আমাদের অন্তরগুলো মিলবে, পরস্পর সম্পর্ক ঠিক হবে।’
এরপর সম্মানিত খতিব সাহেব পুনরায় পাঠ করেন,
اللَّهُمَّ أَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا، وَاهْدِنَا سُبُلَ السَّلَامِ
দোয়ার অর্থ এবং ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ আমাদেরকে শান্তির রাস্তা দেখান। আল্লাহর কাছে বলেন আমাদেরকে শান্তি রাস্তা দেখান। তো শান্তির রাস্তা কুরআন হাদিসে আল্লাহ আমাদেরকে দেখাননি? দেখিয়েছেন শান্তির রাস্তা। তো সেই শান্তির রাস্তা গ্রহণ করার জন্য হে আল্লাহ আমাদের দিলকে প্রস্তুত করে দেন। সেই শান্তির রাস্তা হল, وَتَعَاوَنُوا۟ عَلَى ٱلْبِرِّ وَٱلتَّقْوَىٰۖ— নেকি এবং তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে সমাজকে, সবাই একে অপরের সাহায্য সহযোগিতা করা। আর যেটা পাপ, যেটা জুলুম ওটার মধ্যে কেউ কাউকে সহযোগিতা করবে না। যদি কেউ করতে চায়, তাহলে তার হাত-পা ধরে তাকে বিরত রাখতে হবে। এটা হল নিয়ম।’
মুহতারাম বলেন, ‘জুলুম করবে— তাও আবার বাতিলের পক্ষে! যদি তাদের ব্যাপারে নমনীয় হয়, তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়, যা ইচ্ছা তা বলবে, যা ইচ্ছা তা করবে; তাহলে সমাজের মধ্যে কখনো ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে না। দেশের মধ্যে কখনো স্থিতিশীলতা আসবেনা। আল্লাহর দেয়া মানদণ্ড
وَتَعَاوَنُوا۟ عَلَى ٱلْبِرِّ وَٱلتَّقْوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُوا۟ عَلَى ٱلْإِثْمِ وَٱلْعُدْوَٰنِۚ
(অর্থ: তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না)— এটাকে ধরতে হবে।
এরপরে মুহতারাম বলেন, وَاهْدِنَا سُبُلَ السَّلَامِ— শান্তির রাস্তা আল্লাহ আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন। কুরআন, হাদীস, শরীয়তের বিধান—এখন এটার উপর আমাদেরকে উঠতে হবে, আমাদেরকে পরিচালিত করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে আমাদেরকে পরিচালিত করেন শান্তির রাস্তায়।
এরপরে মুহতারাম পাঠ করেন, وَنَجِّنَا مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ— হে আল্লাহ, আপনি যত অন্ধকার আছে সব অন্ধকার থেকে আমাদেরকে বের করেন। আলোর পথে নিয়ে আসেন।’ দোয়ার অর্থ পেশ করে মুহতারাম বলেন, ‘এই লম্বা দোয়া পরে আবার সময় হলে কোন সময় বলব, ইনশাল্লাহ।’
দোয়ার প্রতি খতিব সাহেবের উৎসাহ
সবশেষে সম্মানিত খতিব সাহেব দোয়া সম্পর্কে মুসল্লিদেরকে গুরুত্বপূর্ণ উৎসাহ প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘দোয়া! সব সময় দোয়া। আর যে কোনো সময় আপনার দোয়া করতে মনে চাচ্ছে, ব্যাস আপনি আল্লাহর হামদ–সানা পড়েন। দরুদ শরিফ পড়েন। দোয়া করতে থাকেন। হাত উঠিয়ে করতে হবে না। হাত উঠিয়ে নয়, আপনি এমনিই দোয়া করেন।
যদি পানাহার হালাল হয়, আর কোন জুলুম ও গুনাহের জন্য দোয়া না করেন, তাহলে আপনার দোয়া অবশ্যই কবুল হবে। আপনার দোয়ার ফল তাৎক্ষণিকও পেতে পারেন, কিছুদিন পরেও পেতে পারেন । দুনিয়াতেও পেতে পারেন আখেরাতেও পেতে পারেন। আপনি যেভাবে দোয়ার ফল পাওয়ার চিন্তা করছেন, সেভাবেই পেতে পারেন। অন্যভাবেও পেতে পারেন, কিন্তু দোয়া মিস নাই। আল্লাহ দোয়া অবশ্যই কবুল করবেন।
পরিশেষে মুহতারাম পাঠ করেন,
واذا سالك عبادي عني فاني قريب اجيب دعوه الداعي اذا دعاني فليستجيبوا لي وليؤمنوا بي لعلهم يرشدون.