কাশ্মিরের দীর্ঘদিনের সংঘাত আবারও এক ভীতিকর মোড় নিচ্ছে। এবার এর ছায়া পড়েছে গুজ্জর সম্প্রদায়ের ওপর। এই পশুপালন-নির্ভর গোষ্ঠীটি বহু বছর ধরে সমাজের প্রান্তে পড়ে আছে। আর এবার তাদের ওপর নেমে এসেছে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, হেফাজতে মৃত্যু এবং সহিংসতার ভয়ার্ত ছায়া।
সম্প্রতি আল-জাজিরার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের হৃদয়বিদারক বর্ণনা পুরনো অভিযোগগুলো আবার সামনে এনেছে। অভিযোগগুলো হলো, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকার যেখানে কাশ্মিরের স্বাভাবিক পরিস্থিতির দাবি করছে, সেখানে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে—প্রতিনিয়তই মানুষ মরছে, নিখোঁজ হচ্ছে, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
এই ভয়াবহতার প্রতীক হয়ে উঠেছে কুলগাম জেলার দুই ভাই—রিয়াজ ও শওকত আহমদের মৃত্যু। তারা ফেব্রুয়ারিতে নিখোঁজ হন। কিছুদিন পর তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায় একটি খালে। কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা হয়তো আত্মহত্যা করেছে বা পানিতে ডুবে মারা গেছেন। কিন্তু তাদের পরিবার এবং স্থানীয়রা এই দাবি মানতে রাজি নন। তারা বলছেন, মৃতদেহে মারধরের স্পষ্ট চিহ্ন ছিল। পাশাপাশি একই সময় মুখতার আহমেদ আওয়ান নামে আরেক যুবক নিখোঁজ হন। যার খোঁজ এখনও মেলেনি।
গুজ্জর সম্প্রদায় এমনিতেই সমাজের একেবারে প্রান্তিক একটি গোষ্ঠী। তাদের বসবাস দূরবর্তী অঞ্চলে। রাজনৈতিক প্রভাবও প্রায় নেই। ফলে তারা সহিংসতার শিকার হলে প্রতিরক্ষা করার মতো অবস্থানে থাকে না।
নির্যাতনের ভিডিও করে আত্মহত্যা
এর আগে ৬ ফেব্রুয়ারি পেরোডি কাথুয়ার ২৫ বছর বয়সী যুবক মাখন দিন আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ড করেন। তাতে জানান, পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী তাকে নির্যাতন করেছে এবং মিথ্যা অভিযোগ স্বীকারে বাধ্য করার চেষ্টা করেছে। ভিডিওতে তিনি তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্দয় আচরণের বিস্তারিত বিবরণ দেন। ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এরপর নিরাপত্তা বাহিনী পাল্টা অভিযান চালায়। যেসব সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা ভিডিওটি ছড়িয়েছিলেন, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে খবর আসে, ভারতের দরিদ্র রাজ্যগুলো থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকরাও হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন। সরকার বলছে, এসবের পেছনে জঙ্গিরা জড়িত। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এটা একটি বড় পরিকল্পনার অংশ। একজন শ্রীনগরভিত্তিক মানবাধিকার আইনজীবী বলেন, ‘এই শ্রমিকরা একটি দাবার গুটি মাত্র। তাদের নিখোঁজ করে সবাইকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে—কাশ্মিরে কেউ নিরাপদ নয়।’
পুঞ্চে সেনাবাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পুঞ্চে ঘটে আরেকক নৃশংস ঘটনা। সেনাবাহিনীর হাতে আটক তিনজন—শাব্বির আহমেদ, সাফির আহমেদ এবং মোহাম্মদ শওকত—নিহত হন। তাদের আটক করা হয়েছিল সেনা কনভয়ে হামলার পর সন্দেহভাজন হিসেবে। কয়েকদিন পর তাদের মৃতদেহ পরিবারগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়। দেহে স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। এটিই প্রকাশ করে দেয় যে, অনেক সময় জঙ্গি দমন অভিযানের আড়ালে চলছে বিচারবহির্ভূত শাস্তি।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া এতটাই তীব্র ছিল যে, রাজৌরি-পুঞ্চের মতো এলাকাও—যা সাধারণত জঙ্গিবাদে সহানুভূতিশীল নয়—প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি তীব্র ভাষায় প্রশ্ন করেন, ’এটাই কি নতুন কাশ্মির?’ তিনি জানান, টোপা পির গ্রামের আরও ১২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, যারা একই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নাতিকে সেনা স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত
তিনজন নিহতের একজন শাব্বির আহমেদের বাবা ওয়ালি মোহাম্মদ বলেন, ছেলের মৃত্যু কোনোদিন ভুলতে পারব না। কিন্তু আমরা চাই পরবর্তী প্রজন্ম সুযোগ পাক। তাই নাতিকে সেনা স্কুলে পাঠাব। তার এই বক্তব্যে ফুটে ওঠে—নির্যাতনের পরও পরিবারগুলো কী অসহায়ভাবে ভবিষ্যতের জন্য আপোস করতে বাধ্য হচ্ছে।
ভুয়া এনকাউন্টার: পুরনো ইতিহাস, নতুন প্রমাণ
২০২০ সালে শপিয়ানের আমশিপোরা গ্রামে তিনজন কাশ্মিরি দিনমজুর—এর মধ্যে একজন কিশোরও ছিলেন—একটি বাগানে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পরে তাদের বিদেশি জঙ্গি হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং সেনারা ২০ লাখ টাকার পুরস্কার দাবি করে। পরে তদন্তে দেখা যায়, তারা ছিলেন নিরীহ শ্রমিক।
এটা প্রথম নয়। ২০০০ সালের পাঠরিবাল ‘ভুয়া এনকাউন্টার’ কাণ্ডে পাঁচজন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করা হয়। তাদের ৩৫ জন শিখ হত্যার দোষে দোষী করা হয়। যদিও পরে প্রমাণিত হয় অভিযোগ মিথ্যা। এমনকি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (CBI) পাঁচ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলেও, সেনাবাহিনী ‘আফস্পা’ আইন দেখিয়ে বিচার এড়িয়ে যায়।
২০১০ সালের মাচিল ঘটনাতেও তিনজন শ্রমিককে ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়। যদিও পাঁচজন সেনা সদস্যকে সামরিক আদালত শাস্তি দিয়েছিল। কিন্তু শাস্তি এতটাই হালকা ছিল যে, মানবাধিকার কর্মীরা এটিকে ’প্রতীকী শাস্তি’ বলে অভিহিত করেন। বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী পারভেজ ইমরোজ বলেন, মাচিল ছিল অপরাধ স্বীকারের বিরল ঘটনা। কিন্তু এতে শাস্তি এমন হয় যে, মনে হয়—আইন নিজেদের লোকদেরই রক্ষা করে।
এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দেয়—অতিরিক্ত পুরস্কার এবং পদোন্নতির লোভে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার প্রবণতা কেমন ছিল ভারতীয় সেনাদের মাঝে। আর ‘আফস্পা’ আইনের আশ্রয়ে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
যন্ত্রণা ও বিচারহীনতার দীর্ঘ ইতিহাস
অফিসিয়াল নয়, এমন অনেক মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে—১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মিরে প্রাণ হারিয়েছে ৯৬ হাজারেরও বেশি মানুষ। ৮ হাজারেরও বেশি মানুষ আজও নিখোঁজ। গুজ্জর সম্প্রদায়ের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। তারা একদিকে বরাবরই রাষ্ট্রের সন্দেহের চোখে পড়ে আছে।
এ অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন ভাবমূর্তি পাল্টাতে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প, স্কুল এবং যুব উৎসব চালু করছে—তখন অনেকেই তা গুরুত্ব দিতে পারছে না। পুঞ্চ হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেন, “
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা থাকবে। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস ফেরেনি। কারণ, এমন আশ্বাস এর আগেও বহুবার দেওয়া হয়েছে।
১৯৯০ সালের কুনান-পোশপোরা গণধর্ষণ মামলার ভুক্তভোগী একজন নারী বলেন, আমরা অনেক শুনেছি। এইসব মিথ্যা প্রতিশ্রুতি! বাস্তবে কিছুই বদলায় না।
নামহীন কবর, অজানা কান্না
পাঠরিবাল থেকে পুঞ্চ—কাশ্মিরের ইতিহাস জুড়ে রয়ে গেছে বিচারহীনতা, নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ছাপ। গুজ্জর সম্প্রদায়ের যন্ত্রণা, মাখন দিনের আত্মহত্যা এবং বাইরের শ্রমিকদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা—সবই মিলিয়ে বোঝায়, এখনো সত্যের কণ্ঠরোধ হচ্ছে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
যতদিন না কাঠামোগত পরিবর্তন আসে, ততদিন কাশ্মিরের এই নিঃশব্দ যন্ত্রণা চলতেই থাকবে। থাকবে নামহীন কবর, জবাবহীন কান্না, আর এক নিষ্ঠুর বিচারহীন ভবিষ্যৎ।
সূত্র: এজে
উপমহাদেশ ডেস্ক
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link
- উপমহাদেশ ডেস্ক#molongui-disabled-link