নিউজনেস্ট

ঈমান ও আমলের শিক্ষা: কর্মক্ষেত্রে দীনী পরিবেশের গুরুত্ব

ঈমান ও আমলের শিক্ষা: কর্মক্ষেত্রে দীনী পরিবেশের গুরুত্ব
ঈমান ও আমলের শিক্ষা: কর্মক্ষেত্রে দীনী পরিবেশের গুরুত্ব। ছবি: নিউজনেস্ট

জাতীয় মসজিদ বাইতুল মােকাররমের সম্মানিত খতিব মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ গতকাল ১২:৩৫ মিনিটে মিম্বারে আরোহণ করেন। প্রথমেই সকলকে সালাম পেশ করেন, আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহ…

হামদ-সানা পাঠ করেন। তারপর খুতবাপূর্ব বয়ান পেশ করেন মুসল্লীদের সমীপে। নিম্নে হযরতের সম্পূর্ণ বয়ানের অনুলিখন পেশ করা হলো—

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে জুমার সালাত আদায় করার তৌফিক দান করেছেন এবং তাঁর ঘর মসজিদে হাজির হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। এজন্য আমরা আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করছি। আলহামদুলিল্লাহ।

আজ আমি কুরআনুল কারিমের ৩১ নম্বর সুরা, সুরা লোকমান-এর ৩৩ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করেছি। সেখানে আল্লাহ তাআলা বলেন:

يا ايها الناس اتقوا ربكم واخشوا يوما لا يجزي والد عن ولده ولا مولود هو جاز عن والده شيئا ان وعد الله حق فلا تغرنكم الحياة الدنيا ولا يغرنكم بالله الغرور

‘হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো এবং সেই দিনের ভয় করো, যেদিন পিতা তার সন্তানের কোন কাজে আসবে না, আর সন্তানও তার পিতার কোন কাজে আসবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। সুতরাং তোমাদের দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে এবং আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারক যেন তোমাদের প্রতারিত না করে।’ (সুরা লোকমান: ৩৩)

কুরআনে আল্লাহ কখনো মুমিনদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন, আবার কখনো সমগ্র মানবজাতির প্রতি আহ্বান জানান। এই আয়াতে আল্লাহ পুরো মানবজাতির প্রতি সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো।’ যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদের রবও আল্লাহ এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি, তাদেরও রব আল্লাহ। তাই আল্লাহ সমগ্র মানবজাতিকে বলেছেন, তাঁকে ভয় করতে।

যদি মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভয় এবং শ্রদ্ধা থাকে, তবে সে অবশ্যই আল্লাহ যেসব কাজ হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকবে এবং আল্লাহর সমস্ত বিধান মেনে চলবে। যারা মুসলিম, তারা কুরআন, সুন্নাহ এবং ইসলামী শরিয়ার মধ্যে আল্লাহর বিধান পেয়েছে। আর অমুসলিমদের কথা হচ্ছে, যদি তারা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তারাও সেসব বিধান পেয়ে যাবে।

আয়াতের শেষ অংশে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: ‘ঐদিনের ভয় করো, যেদিন কেউ কারো উপকারে আসবে না।’ কেয়ামতের দিন পিতা তার সন্তানের জন্য কিছু করতে পারবে না এবং সন্তানও পিতার জন্য কিছু করতে পারবে না। পিতা যদি হিসাব-নিকাশে সমস্যায় পড়ে, তখন সে সন্তানের সাহায্য চাইতে পারে। কিন্তু সেদিন কেউ কারো সহায়ক হবে না।

একইভাবে সন্তান যদি বিপদে পড়ে, সে পিতার সাহায্য চাইলেও তা সম্ভব হবে না। দুনিয়ার জীবনে আমরা অভ্যস্ত, কোন সমস্যায় পড়লে পরিবার-পরিজন বা আত্মীয়-স্বজন পাশে দাঁড়ায়। অনেক সময় রাজনৈতিক বা দলীয় সাহায্যও পাওয়া যায়। উপর থেকে ফোন বা সুপারিশের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু কেয়ামতের দিন এসব কিছুই থাকবে না। সেদিন কেউ কারো পক্ষে সুপারিশ করতে পারবে না। আল্লাহর সামনে একমাত্র আমলই বিচারযোগ্য হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কেয়ামতের দিন কেউ কারো উপকারে আসবে না। দুনিয়ার জীবনে আমরা মা-বাবা বা সন্তানদের ওপর নির্ভর করি, কিন্তু সেই দিন সন্তান মা-বাবার, আর মা-বাবা সন্তানের কোন উপকার করতে পারবে না। তবে একটি বিশেষ শর্তে সন্তান মা-বাবার কাজে আসতে পারে, আর তা হলো সন্তানকে যদি নেককার বানানো যায়।

যদি আমরা সন্তানকে নেককার বানাতে পারি, তবে সে আমাদের জন্য দোয়া করুক বা না করুক, তার নেক আমলের সওয়াব আমাদের আমলনামায় যুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলা এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি সন্তান যদি নেক হয়, তবে সে স্বাভাবিকভাবেই মা-বাবার জন্য দোয়া করবে। এজন্য মৃত্যুর আগে আমাদের ব্যবস্থা করতে হবে, যেন মৃত্যুর পরেও সওয়াব চলতে থাকে।

হাদিসে উল্লেখ আছে, এমন কিছু কাজ করতে হবে যার সওয়াব মৃত্যুর পরেও চলমান থাকবে। এর একটি বড় উদাহরণ হলো, নেক সন্তান রেখে যাওয়া। যতদিন সন্তান বেঁচে থাকবে, সে যত ভালো কাজ করবে, তার সওয়াব যেমন সে পাবে, তেমনি তার সমপরিমাণ সওয়াব আল্লাহ আমাদের আমলনামায় যুক্ত করবেন। আরেকটি উদাহরণ হলো সদকায়ে জারিয়া। অর্থাৎ এমন দান বা কাজ করা যা দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের উপকারে আসে। যেমন টিউবওয়েল বসানো, রাস্তা তৈরি করা, মসজিদ নির্মাণ করা, কিংবা জনকল্যাণমূলক যেকোন কাজ।

হাদিসে এসেছে, যদি কোনো মসজিদ বানানো হয়, এমনকি সেই মসজিদ যতটুকু ছোট হোক, আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করবেন। অর্থাৎ মসজিদ বানানোর কাজে সামান্য অংশগ্রহণ করলেও আল্লাহ বিপুল সওয়াব দান করেন। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, মসজিদ নির্মাণ বা অন্য দানের ক্ষেত্রে অহংকার বা বাহাদুরি দেখানো উচিত নয়। যেমন, ‘এখানে শুধু আমার টাকায় মসজিদ হবে’ এমন জিদ করা ঠিক নয়। বরং সকলের অংশগ্রহণে কাজ করা উচিত। হতে পারে কারো টাকার বরকত বা ইখলাস আপনার চেয়েও বেশি, যা আল্লাহর দরবারে আপনার অংশকে কবুল করার মাধ্যম হতে পারে।

হাদিসে উল্লেখিত কিছু সদকায়ে জারিয়ার উদাহরণ: কূপ খনন করা, মুসাফিরখানা তৈরি করা, মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ, রাস্তা বা সেতু তৈরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি (যেখানে ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে) এগুলো সবই এমন কাজ, যার উপকারিতা যতদিন চলবে, ততদিন আমলনামায় সওয়াব যুক্ত হতে থাকবে। তবে শর্ত হলো, কাজটি হালাল পথে এবং সঠিক নিয়মে হতে হবে।

নেক কাজ করতে হলে অবশ্যই সঠিক নিয়মে করতে হবে। যেমন, মসজিদ নির্মাণ বা জনকল্যাণমূলক ভবন তৈরি করতে হলে জায়গা বৈধ হতে হবে। যদি কোন সরকারি জমি ব্যবহার করতে হয়, তবে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। কারণ অন্যায় বা জুলুমের মাধ্যমে করা কোন কাজ কবুল হবে না। কেয়ামতের দিন সামান্যতম অন্যায়েরও জবাব দিতে হবে।

যদি কেউ স্কুল-কলেজ তৈরি করেন, তবে সেখানে অবশ্যই ইসলামি নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। যেমন, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা নামাজি হবে, ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু শেখানো হবে না। এমন নীতিমালা মেনে কাজ করলে, সেটিও সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। নামাজের ছুটি থাকতে হবে, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নামাজের গুরুত্ব থাকতে হবে। এই না যে, একটা জায়গা নির্ধারিত করে দিলাম, যারা পড়তে চায় তারা পড়বে। এটাতো অমুসলিম দেশের মধ্যে থাকে, যারা পড়তে চায় তারা পড়ো। এটা অমুসলিম দেশেও থাকে।

মুসলিম দেশের মধ্যে একটা স্কুল, একটা কলেজ, একটা ভার্সিটি— সেখানে নামাজের ব্যবস্থা আছে। যে খুশি সে পড়বে। শুধু নামাজের ব্যবস্থা আছে এটা হলো নাকি? সবাই; প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক থেকে নিয়ে সব শিক্ষক নামায পড়বে। দু চারজন হয়তাে থাকতে পারে অন্য ধর্মের, তাদের বিষয় ভিন্ন।

প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নামাজের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সবাই নামাজ আদায় করবে। কারণ, সবাই মুসলমান সবার উপরে নামাজ ফরজ। ঠিক কিনা? ঠিক। গার্মেন্টস আছে। গার্মেন্টসের শুধু একটা নামাজের জায়গা রেখে দিলেন, এটা হয় না। গার্মেন্টসের মালিক মুসলমান। যারা কাজ করছে সবাই মুসলমান। নামাজের জায়গা রেখে দিলে হবে মা। নামাজের ব্যবস্থা করতে হবে। সবাই নামাজ আদায় করবে। সবাই একসাথে পারবে না বারি বারি করে নামাজ পড়বে।

নামাজ আদায় এটা নিয়মের মধ্যে থাকবে। বড় বস থেকে নিয়ে যত জন আছে সকলেই নামাজ আদায় করবে। এবং নামাজ শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে। প্রতি নামাজের পরে ১৫-২০ মিনিট নামাজ শেখাবে মানুষকে—সে ব্যবস্থা থাকতে হবে গার্মেন্টসে। যেকোনো অফিস আদালতে; সরকারি যেকোনো অফিসে নামাযের জায়গা থাকে কিনা? থাকে।‌ থাকাটা স্বাভাবিক। যেকোনো অফিসে নামাজের জায়গা থাকে এটাই স্বাভাবিক। যে কোন মার্কেটে নামাজের জায়গা থাকে।

এই শুধু নামাজের জায়গা রেখে দেওয়া, এটা যথেষ্ট না। প্রথম কথা হল, খালি নামাজের জায়গা রাখবেন না। মসজিদ রাখবেন। নামাজের জায়গা আর মসজিদের মাঝে পার্থক্য আছে। মসজিদ হলো, যে জায়গা মসজিদের জন্য ওয়াকফ। আল্লাহকে রাজি-খুশি খুশি করার জন্য মসজিদের জন্য যে জায়গা ওয়াকফ করে দেয়া হয়। এটা সবসময়ই। এই ভবনের, এই তলার বা এই ফ্ল্যাটের অংশবিশেষ এটা সবসময়ের মসজিদ।

কিন্তু সব ক্ষেত্রে এত বড় জায়গা পাওয়া যায় না। জায়গার সংকট থাকে। সেজন্য অনেক তলার একটা ভবন, সেই ভবনের মধ্যে যদি একটা সম্পূর্ণ ফ্লোর বা ফ্লোরের অংশবিশেষ মসজিদের জন্য বরাদ্দ করে দেয়া হয়—এটা মসজিদের জন্য ওয়াকফ। এ ভবন আবার ভাঙবে আবার নতুন করে হবে যখন নতুন করে হবে তখন আবার এই অংশ মসজিদ হিসেবে ব্যবহার হবে। এটাও এক প্রকারের মসজিদ। এটাও মসজিদের সওয়াব হবে।

জায়গার সংকটের কারণে এই ছাড় শরিয়তে ফুকাহায়ে কেরাম, এই ছাড়ের কথা বলেছেন। কিন্তু শুধু একটা জায়গা নামাজের স্থান। এই নামাজের স্থান যেকোনো সময় পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, যেকোনো সময় এখানে অন্য কিছু হয়ে যেতে পারে। এটা মসজিদের হুকুম রাখে না। এটাকে মসজিদ বলা যায় না। 

গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, অন্যান্য ফ্যাক্টরি এবং সরকারি অফিস, সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানে যেমন থাকতে হবে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা, তেমনি থাকতে হবে নামাজ শেখানোর ব্যবস্থা। নামাজের সাথে দীন শিখিয়ে দিবে, দীনের মৌলিক বিষয় গুলো। হালাল–হারাম, আল্লাহ কি ফরজ করেছেন, কি হারাম করেছেন সেগুলো শেখাতে হবে।

শ্রমিকরা সবাই যদি আমানতের মাসআলা বুঝে, খেয়ানত হারাম, আমানত আদায় করা ফরজ— এটা যদি বুঝে, তাহলে তাদেরকে যত সহজে ব্যবহার করে ষড়যন্ত্রকারীরা, মালিকের বিরুদ্ধে–মালিক জুলুম না করলেও ব্যবহার করে, সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, যত সহজে ব্যবহার করা হয় সেভাবে কি ব্যবহার করা যাবে; যদি তাদেরকে দীন ঈমান শেখানো হয়? পারবে না। দীন ঈমান শেখানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে, দীন ঈমান শেখানোর যে ব্যবস্থা রাখবেন সেটাই সদকায়ে জারিয়া।

একদিন তবলিগে নিয়ে গেলেন সেটাই সদকায়ে জারিয়াহ। তবে তাবলিগ সঠিক তরিকায় হতে হবে। ইকরামুল মুসলিমিনের ওয়াজ করলাম, পরে আবার মানুষকে জবাই করে দিলাম ধরে, হাত-পা ভেঙে দিলাম— এটা তাবলিগ না। এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন— এজন্য সবাই দাবি করে সমতা হতে হবে, আমরা বৈষম্যের শিকার! সমতা কাকে বলে?

একজন ইকরামুল মুসলিমিনের তাবলিগ করে, আচরণও ইকরামুল মুসলিমিনের করে। আরেকজন ইকরামুল মুসলিমিনের নাম ব্যবহার করে; কিন্তু আচরণ করে মানুষের হাত ভাঙ্গে, পা ভাঙ্গে, মানুষকে জবাই করে— এই দুই তাবলিগ এক হলো? তবলিগ যদি দুই রকমের হয়, তবে তুমি সমান অধিকারের দাবি কিভাবে করো? দুই তাবলিগ এক হতে হবে। তাবলিগের ছয় নম্বরে ইকরামুল মুসলিমিনের উসুল আছে। এখন কেউ ইকরামুল মুসলিমিন বাস্তবে করে আর কেউ বাস্তবে করে না। যদি তােমার তাবলিগ দুই রকমের হয় তবে তুমি সমান অধিকারের দাবী চাও কীভাবে? তাবলিগটা ঠিক করো আগে! 

তাবলিগ হলো ঈমান শেখার জন্য। এক নম্বর ঈমানের মধ্যে প্রথম কথাটা, ‘আকীদা ঠিক হতে হবে।’ যে তাবলিগ জামাত তাদের দাবি অনুসারে মূলধারা, অথচ তার গুরু নবী–রাসূলের সমালোচনা করে, ইসলামের মধ্যে নতুন নতুন বিধান আবিষ্কার করে দিল্লির মিম্বরে বসে, বড় বড় ইজতেমার মধ্যে। এখন বাংলাদেশের ইজতেমাতেও করতে চায়। হুজুররা বলেন যে, না। গোমরাহির কথা, নবী–রাসূলের সমালোচনা, শরিয়তের বিধান পরিবর্তন, শরিয়তে উসূল পরিবর্তন— এটা যে করবে সে এ দেশের ইজতেমাতে এসে না করুক। 

আমি আক্রমণাত্মক কথা বলা, উত্তেজনামূলক কথা বলা— এটার সমর্থন করি না। যদি শুরায়ে নেজামের তাবলিগ তারা কোন অন্যায় করে, আমি কখনো সমর্থন করবো না। কিন্তু আমি বলছি, মূল দাবি যেটা— গোমরাহির কথা প্রচার করে এক লোক, নবি রাসুলের সমালোচনা করে এক লোক; তাকেই তোমাদেরকে এই দেশে এই ইজতেমার জন্য আনতেই হবে; এই যে জিদ ধরেছো— এটা কি হেদায়েতের তাবলিগ না গোমরাহির তাবলিগ?

গােমরাহির তরিকায় করলে এই তাবলিগ কাজে আসবে না আপনার। যদি সহি তরিকায় করেন তাহলে এই তাবলিগ হবে সাদাকায়ে জারিয়া। সকল হেফজখানা সাদাকায়ে জারিয়া, সকল মাদ্রাসা সাদাকায়ে জারিয়া। আজ আপনাদেরকে এসব কথা বলতে চাইনি। কিন্তু কথাপ্রসঙ্গে কথাগুলো চলে এসেছে। 

মসজিদ আল্লাহর ঘর। আল্লাহর সবচেয়ে বড় বরকতপূর্ণ হেদায়েতের কেন্দ্র হচ্ছে বাইতুল্লাহ। ওটার নামই বাইতুল্লাহ। আল্লাহর ঘর। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওটাকে বাইতুল্লাহ বলা হয়। সকল মসজিদই আল্লাহর ঘর। যেটাকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য, দীনের জন্য খাস করে দেওয়া হয়—ওটার ইকরাম আল্লাহর পক্ষ থেকে। ওটাকে বাইতুল্লাহ বলা হয়। 

সব মসজিদ বাইতুল্লাহ, মসজিদে নববির শাখা। এখন যেটা আমি বলতে চাচ্ছি যেরকম মসজিদ আল্লাহর ঘর। এক নম্বরে বাইতুল্লাহ। দুই নাম্বার মসজিদ। তিন নাম্বার সকল মাদ্রাসা মক্তব হেফজখানা দীনের এলেমের চর্চা কেন্দ্র দীনী বিষয়ে শেখা এবং শেখানোর জন্য যত কেন্দ্র এবং যতগুলো ঘর আছে দাওয়াতের মারকাজ, তাবলিগের মারকাজ।

আল্লাহর দীন চর্চার জন্য, আল্লাহর দীন শেখানোর জন্য, কোরআন শেখানোর জন্য, নামাজ শেখানোর জন্য যে কেউ একটা ঘর বানাবে, একটা ভবন বানাবে, সেটাও আল্লাহর ঘর। এখন বলবেন, মসজিদ আল্লাহর ঘর এ তো আমরা আগে থেকেই জানি! কিন্তু মাদ্রাসা আল্লাহর ঘর এটার দলিল কি? এটা বেশি প্রসিদ্ধ না তো! বরং অনেক মানুষ বলে যে, মসজিদ আল্লাহর ঘর, মাদ্রাসা নবীর ঘর। নবীর ঘর এজন্য বলতে পারি যে, নবীর মাধ্যমে আমরা দীন-শরীয়ত পেয়েছি! তো দীন শরীয়তের চর্চা যেখানে হবে সেটাকে নবীর ঘর বলতে সমস্যা আছে? আপত্তি নেই!

এটা শুধু নবীর ঘর না, আল্লাহরও ঘর। আমি এর দুটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। একটা তফসিরের কিতাব থেকে আরেকটা হাদিসের কিতাব থেকে। তফসিরের কিতাবের উদ্ধৃতি; সুরা নুরের ৩৬ ও ৩৭ নাম্বার আয়াত।

فِى بُيُوتٍ أَذِنَ ٱللَّهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا ٱسْمُهُۥ يُسَبِّحُ لَهُۥ فِيهَا بِٱلْغُدُوِّ وَٱلْءَاصَالِ رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَٰرَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ ٱللَّهِ وَإِقَامِ ٱلصَّلَوٰةِ وَإِيتَآءِ ٱلزَّكَوٰةِۙ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ ٱلْقُلُوبُ وَٱلْأَبْصَٰرُ

অর্থ: আল্লাহ যে ঘরগুলোকে উচ্চমর্যাদা দিতে এবং তাতে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে আদেশ করেছেন, তাতে সকাল-সন্ধ্যায় তাসবিহ পাঠ করে এমন লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচাকেনা আল্লাহর স্মরণ, নামায কায়েম ও জাকাত আদায় থেকে গাফেল করতে পারে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যে দিন অন্তর ও দৃষ্টি ওলট-পালট হয়ে যাবে।

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন فِى بُيُوتٍ। بُيُوت এটা بيت এর বহুবচন। এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা কিছু ঘরের কথা বলেছেন। যে ঘরের মধ্যে আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর তসবি পাঠ করে। আল্লাহর জিকির করে। ওই ঘরগুলো কী? আল্লাহর ঘর। এই আয়াতের তফসিরে আল বাহরুল মুহিত ও তাফসিরে মারেফুল কোরআনে বলা হয়েছে: মারেফুল কোরআন তো আপনাদের সবার পরিচিত, বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। আল বাহরুল মুহিত এখনো বাংলা ভাষায় অনুবাদ হয়নি আমার জানামতে। বা ইংরেজিতেও হয়ত অনুবাদ হয়নি।

মারেফুল কোরআন মুফতি মুহাম্মাদ শফি রহিমাহুল্লাহ কতৃক রচিত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকেই বাংলায় আট খন্ডে অনুবাদ হয়েছে। এবং সংক্ষিপ্ত মারেফুল কোরআনও আছে। এই মারেফুল কোরআনের মধ্যেই দেখেন এই আয়াতের অধীনেই, এই ঘরগুলো হলো মসজিদ এবং মাদ্রাসা। যেখানে আল্লাহর দীনের চর্চা হয়, শেখানো হয়, এলেম হয়, জিকির হয়, আমল হয়; সবই এ ঘর।

এ بُيُوت দ্বারা যেমন মসজিদ উদ্দেশ্য, ওই ঘরগুলোও উদ্দেশ্য। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। সুরা নুরের ৩৬ ও ৩৭ নম্বর আয়াতে তাফসিরে মারেফুল কুরআনের মধ্যে এই আয়াতের অধীনে দেখবেন, আর যারা আরবি জানেন তারা আল বাহরুল মুহিত দেখবেন, পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ!

আরেকটা, হাদিসের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। মুসলিম শরিফসহ হাদিসের বিভিন্ন কিতাবে আল্লাহর নবীর একটি হাদিস আছে। সে হাদিসের নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: (মুসলিম, হাদিস: ২৬৯৯)

ما اجتمع قوم في بيت من بيوت الله يتلون كتاب الله ويتدارسونه فيما بينهم، إلا نزلت عليهم السكينة، وغشيتهم الرحمة، وحفتهم .الملائكة، وذكرهم الله فيمن عنده

আল্লাহর বান্দারা অল্প কিছু লোক বা বেশি লোক আল্লাহর কোন ঘরে যদি একত্র হয় এবং তারা কোরআন তেলাওয়াত করে কোরআন সহি শুদ্ধ তেলাওয়াত শিখে তার অর্থ নিয়ে নিজেরা পরস্পর মুজাকারা করে, শিখে এবং শেখায়, তাহলে তাদের উপর শান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহ তাদেরকে রহমত দিয়ে বেষ্টন করে নেন। ফেরেশতারা তাদেরকে বেষ্টন করে নেয় আসমান পর্যন্ত। এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর দরবারে এই লোকদের কথা আলোচনা করেন, দেখো আমার বান্দারা কি করছে? আমার কোরআন শিখছে শেখাচ্ছে, তেলাওয়াত করছে, পড়ছে, পড়াচ্ছে।

তো এখানে বলা হয়েছে আল্লাহর কোন ঘর। মসজিদ শব্দ বলা হয়নি। এ হাদিসটা মিশকাত শরিফের মধ্যেও আছে। মেশকাত শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ الكاشف عن حقائق السنن সহ আরও অনেক কিতাবে বলা হয়েছে, নবি করিম ﷺ এখানে মসজিদ শব্দ বলেননি ‘আল্লাহর যেকোনো ঘর’ এটা বলেছেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যদি মসজিদে বসে কোরআন শিখে এবং শেখায় তাহলে যেমন এ সওয়াব পাওয়া যাবে, তেমনি কোন মাদরাসাতে, কোন খানকায় অর্থাৎ সহিহ তরিকায় দীন ও ইলমের চর্চার জন্য যেকোনো ঘর বানানো হয়েছে, সে ঘরে বসে যদি এরূপ আমল করা হয় তাহলেও এই সওয়াব পাওয়া যাবে। সুবহানাল্লাহ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে হাশরের ময়দানে প্রস্তুতি নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন। যখন কেউ কারো কাজে আসবে না। কাজে আসবে ‘ইল্লাল মুত্তাকুন’। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

ٱلْأَخِلَّآءُ يَوْمَئِذٍۭ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا ٱلْمُتَّقِينَ

সে দিন বন্ধুবর্গ একে অন্যের শত্রু হয়ে যাবে কেবল মুত্তাকিগণ ছাড়া। (সুরা যুখরুফ: আয়াত ৬৭)

দুনিয়ার অন্তরের বন্ধু; কিন্তু হাশরের ময়দানে শত্রু। কিন্তু কোন বন্ধু যদি মুত্তাকি হয় এও মুত্তাকি সে মুত্তাকি তাহলে তারা আখেরাতে শত্রু হবে না। দুনিয়াতে যেমন তারা বন্ধু ছিল আখেরাতেও তারা সেরকম বন্ধু থাকবে। যদি কোন বন্ধু মুত্তাকি হয়। আল্লাহ আমাদেরকে মুত্তাকি বানিয়ে দিন। আমিন।

টিম নিউজনেস্ট
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত