পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষের জন্ম হয়, যারা মরেও অমর হয়ে থাকেন। যুগের পর যুগ যাদের রেখে যাওয়া কীর্তিমালা মানবহৃদয়ে অনুপ্রেরণা যোগায়। ড.আব্দুর রহমান আসসুমাইত ছিলেন তেমনই একজন। চোখে আঙুল দিয়ে যিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, একজন ডাক্তার হয়েও কিভাবে মানবতার মশাল হাতে নিয়ে পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ছুটে যেতে হয়।
জন্ম ও বেড়ে উঠা
একবিংশ শতাব্দীর এই মহান মানুষটি ১৯৪৭ সালের ১৫ই অক্টোবর কুয়েতের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ছোট বেলা থেকেই নম্র, ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের পাশাপাশি তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। মানুষকে আপন করে নেবার সহজাত ক্ষমতা ছিল তার জন্মগত। মানুষের দুঃখ কষ্টে অশ্রুসিক্ত হত তার চোখ। মানুষের কষ্ট লাঘবের চিন্তা তার হৃদয়ে তৈরি করত জাগরণ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ড. আব্দুর রহমান সুমাইতের পড়াশোনা নিজ দেশ কুয়েতেই সম্পন্ন হয়। এরপর ১৯৭২ সালে বাগদাদ মেডিকেল কলেজ ও ১৯৭৪ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিন এবং সার্জারিতে বি,এস সম্পন্ন করার পর গ্রীষ্মপ্রধান দেশের দুর্লভ রোগের উপর ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি কানাডার ম্যাকনিক ইউনিভার্সিটি থেকে মেডিসিনের উপর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন ইন্টারনাল মেডিসিন (আন্ত:মেডিসিন ওষুধ) এবং পাকস্থলী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ।
সেবা ও সাফল্যেভরা কৃতিত্বময় কর্মজীবন
কথায় আছে, ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ ড. আব্দুর রহমান আসসুমাইত তার কর্মময় জীবনকে এভাবেই গঠন করেছিলেন। ইউরোপের সেরা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শেষ করার পর তার সুযোগ ছিল ইউরোপে সুখ ও শান্তিতে ভরা ক্যারিয়ার গড়ার। কিন্তু মানবসেবায় নিবেদিতপ্রাণ ড. সুমাইত আর্ত মানবতার টানে আফ্রিকার সেই দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলে ছুটে যান।
অবশ্য আফ্রিকায় নিজেকে মানবতার সেবায় নিয়োজিত করার পূর্বে কানাডা, ব্রিটেন এবং কুয়েতের হাসপাতালে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসাবে কাজ করেছিলেন। সেবা ও ইসলামের শিক্ষা প্রচারে আফ্রিকার ২৯টি দেশে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। শাসকদের রোষানলে পড়ে খেটেছেন জেল। নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করেন অনেক দাতব্য সংস্থা। আফ্রিকার কালো মানুষগুলোর কল্যাণ চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন তিনি।
আফ্রিকান সমাজে দাওয়াতের কাজ করার জন্য তিনি লিখেছিলেন আফ্রিকান গোত্রগুলোর জীবন-প্রণালী নিয়ে বই। ৯ হাজার ৫০০টি এতিমখানা, ৮শত ৬০টি স্কুল তৈরি করেন তিনি। তানজানিয়া, জানজিবার, কেনিয়ায় ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ৯৫ হাজার শিক্ষার্থীর পড়ালেখার জন্য বৃত্তি প্রদান করেন। ১২৪টি হাসপাতাল, নারীদের জন্য ২১৪টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পানি সঙ্কট নিরসনে ৯ হাজার ৫০০টি কূপ খনন করেন। ৫ হাজার ৭০০টি মসজিদ ও ২০৪টি ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। ৫ কোটি ১০ লাখ কুরআন বিতরণ করে দাওয়ার ময়দানে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন। ফলে আফ্রিকার ২৯টি দেশে ১১ মিলিয়ন (১ কোটি ১০ লাখ) মানুষ তাঁর অনুপ্রেরণায় সুমহান ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন ।
পুরস্কার ও সম্মামনা
ড. আসসুমাইত রাহিমাহুল্লাহ ইসলাম ও মানবতার সেবার জন্য কাতার ফাউন্ডেশন ও দুবাইয়ের পক্ষ থেকে মানবসেবা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও বেনিনের ‘রাষ্ট্রপতি পদক’, কুয়েতের ‘রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক’, সুদান, আজমান ও উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন । ২০০৩ সালে সুদানের বিখ্যাত উম্মে দারমান বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯৬ সালে কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড বা বাদশা ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। যার মূল্য সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সৌদী রিয়াল। তিনি এই পুরস্কার আফ্রিকার হতদরিদ্র মানুষের জন্য দান করেছেন।
ইসলাম ও মানবতার মশালধারী আফ্রিকার দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলের আশার আলো ড. আব্দুর রহমান বিন হামূদ আসসুমাইত ২০১৩ সালের ১৫ই আগস্ট ইন্তেকাল করেন। কিন্তু সেবা ও সাফল্যভরা কৃতিত্বময় কর্মজীবন আজও তাঁকে জীবন্ত ও অবিস্মরণীয় করে রেখেছে ।