শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকেই ভাবছেন, কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাদা আসলে নরসুন্দর ছিলেন? এটা যারা ভাবছেন তাদের আরেকটু চমকে দিয়ে বলি। মূলত বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাদাই আসলে নরসুন্দর ছিলেন। সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাদা ফ্রেডরিক ট্রাম্পের জন্ম ১৮৬৯ সালে হিটলারের দেশ জার্মানির পশ্চিমে একটি ছোট্ট গ্রামের দরিদ্র পরিবারে। দারিদ্র্যের কারণে ট্রাম্পের দাদা ফ্রেডরিক ট্রাম্পের ছোটবেলাতেই হাতে উঠে আসে কাচিঁ আর চিরুনি। কিন্তু জার্মানির আইনে প্রতিটি নাগরিককে দেশটির সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধ্যবাধকতা থাকায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৮৫ সালে ট্রাম্পের দাদা আমেরিকায় পাড়ি জমান। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের দাদা ফ্রেডেরিক অবশ্য নিজের ভাগ্য পরীক্ষাও করতে চেয়েছিলেন।
ভাগ্য পরিক্ষায় ১৬ বছরে আমেরিকায় আসা এক তরুণের নিউইয়র্ক শহরে শুরু হয় নতুন পরীক্ষা। ইংরেজি না জানা ফ্রেডেরিক ট্রাম্প এই শহরের একটি জার্মান সেলুনে শুরু করেন নরসুন্দরের কাজ। তবে ২৩ বছর বয়সে এসে ফ্রেডরিক ট্রাম্প তার জীবনকে নিয়ে ধরেন সম্পূর্ণ নতুন বাজি।
স্বর্ণের খোঁজে সিয়াটলে নতুন উদ্যোগ
আমেরিকায় আসার মাত্র ৬ বছর পর, ১৮৯১ সালে ফ্রেডরিক ট্রাম্প উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার সিয়াটল শহরে গিয়ে খুলে বসেন একটি রেঁস্তোরা। এদিকে আমেরিকার সিয়াটল শহর ছিল মদ্যপান আর দেহব্যবসার জন্য বিখ্যাত। ট্রাম্পের দাদা ফ্রেডরিক ট্রাম্পও সিয়াটলে রেঁস্তোরা খুলে শহরের এই পরিস্থিতির পুরোপুরি ফায়দা নেন। ফ্রেডরিক নিজ রেঁস্তোরায় মহিলাদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করেন এবং দেহব্যবসার ব্যবস্থা করের প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন।
কিন্তু জীবনে অর্থ যার লক্ষ্য, সে তো আর এক জায়গাতেই থেমে থাকার পাত্র নয়। ফলে এর কয়েক বছর পর, ওয়াশিংটনের মন্টে ক্রিস্টো অঞ্চলে সোনার সন্ধান পাওয়া গেছে এমন গুজব শুনে আবার নতুন পথ ধরেন ট্রাম্পের দাদা। কিন্তু সেই যাত্রায় ফ্রেডরিকের লক্ষ্য ওয়াশিংটনের স্বর্ণ ছিল না। ফ্রেডরিক ওয়াশিংটনে গিয়ে সিয়াটলে উপার্জিত কাঁচা টাকা দিয়ে খুলে বসেন একটি নিম্নমানের হোটেল। অল্পদিনেই সেখানে স্বর্ণের সন্ধানে আসা অভিযাত্রীদের আনাগোনায় জমজমাট হয়ে উঠে ফ্রেডরিকের হোটেল।
ফলে কিছুদিন পর যখন স্বর্ণের উন্মাদনা শেষ হয়, ফ্রেডরিক তখন এই গুজবকে কাজে লাগিয়ে সবচে বেশি লাভের মুখ দেখার একজন মানুষ। কিন্তু ফ্রেডরিক বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। ওয়াশিংটনে এত দিনে জমানো সব সম্পত্তি বিক্রি করে সিয়াটেলে ফিরে আসেন।
আবারও স্বর্ণের গুজব, লাভের সন্ধানে ফ্রেডরিক
সিয়াটলে ফ্রেডরিকের জীবন স্বাভাবিকই যাচ্ছিল। কিন্তু আবারও আকাশে উড়তে শুরু করে স্বর্ণের গুজব। এবার গুজবের কেন্দ্রস্থল কানাডার ইউকন অঞ্চল। বরাবরের মত এবারও সেখানে গিয়ে ফ্রেডরিক খুলে বসেন তাঁবুর মতো একটি রেস্তোরাঁ। আর রেস্তোরার জন্য ফ্রেডরিক এমন এক জায়গা নির্বাচন করেন, যেখানে স্বর্ণ না মিললেও অর্থের প্রবাহ ছিল এক প্রকার নিশ্চিত।
ফ্রেডরিকের রেস্তোরার অবস্থান ছিল ‘ডেড হর্স পাস’ নামক একটি বিপজ্জনক পথে। আসলে এই পথে অনেক ঘোড়া পরিশ্রান্ত হয়ে মারা যেত বলে পথটির নাম ছিল ‘ডেড হর্স পাস’। ট্রাম্পের দাদা ফ্রেডরিক সেই মৃত ঘোড়ার মাংসই বিক্রি করে উপার্জন করেন বিপুল সম্পদ।
এরপরের ঘটনা শুধু অঢেল টাকার
১৮৮৫ সাল থেকে জুয়া, দেহব্যবসা আর রেঁস্তোরা ব্যবসা করে ১৮৯৮ সালে ফ্রেডেরিক ট্রাম্প কানাডার বেনেট শহরে খুলে বসেন আরও বড় রেঁস্তোরা। একই সঙ্গে নতুন সেই রেঁস্তোরার নাম ছড়িয়ে দিতে চালু করেন রেঁস্তোরা কেন্দ্রিক দেহব্যবসা। এরপর কয়েক দিনের ব্যবধানে সেখানে চালু করেন জুয়ার ব্যবস্থা।
আর এভাবে অল্প কয়েক দিনের ভেতর কানাডাতেও নিজ রেঁস্তোরাকে জনপ্রিয় বানিয়ে ফেলেন ফ্রেডরিক। কিন্তু কিছুদিন পরে কানাডার আইন-শৃঙ্খলা কঠোর হয়ে উঠলে নিজের রেঁস্তোরার সকল শেয়ার বিক্রি করে বিপুল লাভ নিয়ে ফিরে আসেন পুরনো ঠিকানা সিয়াটলে। তবে কানাডার সেই যাত্রায় ফ্রেডরিকের ভাগ্য ভালই ছিল বলা যায়। কারণ, কানাডা ছাড়ার ৪ বছর পর অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হয়ে যায় ফ্রেডরিকের সেই রেস্তোরাঁ।
প্রত্যাবর্তন এবং প্রত্যাখ্যান
সিয়াটলে ফিরে নিজের সঞ্চয় নিয়ে জার্মানিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ফ্রেডরিক। যেমন ভাবা তেমন কাজ। জীবনের সঞ্চয় নিয়ে জার্মানিতে ফিরে আসেন ফ্রেডরিক। এরপর সেখানে বিয়েও করেন। কিন্তু এবার আর ভাগ্য সহায় হয়নি ফ্রেডরিকের। সেনাবাহিনীতে যোগদান না করে পালানোর কারণে জার্মান প্রশাসন তাকে দেশ ছাড়া করে।
শেষমেশ ১৯০৫ সালে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় ফিরে নিউইয়র্কে থিতু হন অর্থের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো ফ্রেডরিক। নিউইয়র্কে থিতু হয়ে ফ্রেডরিক আবারও বনে যান নরসুন্দর। পরে অবশ্য জমি ব্যবসায় নিজ সঞ্চয় খাটিয়ে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন ফ্রেডরিক। মৃত্যুর সময় তার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩১ হাজার ডলার। আজকের হিসাবে যা প্রায় ৬ লক্ষ ডলারের সমান।
এক জীবন, এক উত্তরাধিকার
মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে মারা যান বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাদা ফ্রেডরিক ট্রাম্প। কিন্তু তার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে বদলে যায় পুত্র ফ্রেড, আর নাতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জীবন। ফ্রেড তার বাবার সঞ্চয়কে কাজে লাগিয়ে সম্পত্তি কিনে গড়ে তোলেন একটি সফল কোম্পানি। পরবর্তীতে যা ট্রাম্প পরিবারকে আমেরিকার ধনকুবের ফ্যামিলিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়।
সূত্র: আল জাজিরা