১২:৩৫ মিনিটে জাতীয় মসজিদের মিম্বারে খুতবাপূর্ব বয়ানের জন্য আসন গ্রহণ করলেন সম্মানিত খতিব মুহতারাম আব্দুল মালেক সাহেব হাফিজাহুল্লাহ। প্রথমেই সবাইকে সালাম দিলেন, আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহ….
হামদ সানা পাঠ করলেন। হামদ-সানা শেষে প্রথমেই মুহতারাম রবের শুকরিয়া আদায় করেন। মুহতারাম বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনেক মেহেরবানী যে আল্লাহ তা্আলা আমাদেরকে তাঁর নিজ অনুগ্রহে তাঁর ফজল ও করমে আমাদের সকলকে হায়াত দান করেছেন এবং আমরা আমাদের জিন্দেগীতে আরেকটি রজব মাস পেয়েছি ”আলহামদুলিল্লাহ”।
রজব ও আরবি ১২ মাসের নাম ও সঠিক উচ্চারণ সম্পর্কে খতিব সাহেব বলেন, চন্দ্র মাস বারোটি আর এই বারোটি মাসের মধ্যে একটি মাস হল এই রজব মাস। আরবি মাসসমূহ হলো, যথাক্রমে মহাররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউল আখিরাহ। যদি বিশুদ্ধ উচ্চারণ করতে চান তাহলে এ মাসের নাম হল রবিউল আখিরাহ। কোরআনের ভাষা এবং আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী এটাই হল সঠিক নাম। যদিও অনেকে এটিকে রবিউল সানি বলে। এরপর হল জুমাদাল উলা, যদিও এটিকে অনেকেই জুমাদিউল আউয়াল বলে। তবে আরবি সঠিক উচ্চারণ হলো জুমাদাল উলা। এরপর হল জুমাদাল আখিরাহ । যদিও এটিকে অনেকেই জুমাদিউল উখর, জুমাদিউল আখিরা বলে। তবে এটি আরবি ব্যাকরণসম্মত নয়।
তবে এগুলো কিন্তু লড়াইয়ের বিষয় বা মতানৈক্যের বিষয় নয়। যে আপনি প্রশ্ন তুলবেন এই মিয়া এগুলো কি বলতেছেন? এগুলো সাধারণ আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী সঠিক উচ্চারণ। তাই এগুলো জেনে রাখা দরকার সে জন্যই বলে রাখলাম।
এরপর হল রজব, শা’বান, রমাদান, শাওয়াল, জুল ক্বয়াদা ও জুল হিজ্জা। এগুলো হলো চন্দ্র হিসেবে আরবি ১২ মাসের আরবি শুদ্ধ নাম। তবে আপনারা যদি মনে করেন যেগুলোকে আমরা বাংলাতেই কিছু একটা বলবো তাহলে বলতে পারেন কোন সমস্যা নেই। আমি শুধু আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী এই ১২ মাসের শুদ্ধ উচ্চারণ কি হবে সেটাই আপনাদেরকে জানিয়ে দিলাম। তিনি আরও বলেন, আমরা আরবি মাসের হিসাব অনুযায়ী ৭ নম্বর মাসে রয়েছি। আর এটা হল রজব মাস। রজব মাসের সাথে আরবী মুরাদ্দাব শব্দ যোগ করে এটাকে রজবুল মুরাদ্দাবও বলা হয়। অর্থাৎ, সম্মানিত মাস। তবে মূল নাম হল রজব, আর এটা সাত নম্বর মাস। আট নম্বর শাবান, নয় নম্বর হলো রমাদান।
সম্মানিত খতিব মুহতারাম আব্দুল মালেক সাহেব হাফিজাহুল্লাহ সম্মানিত চার মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, আর এই ১২ মাসের মধ্যে সম্মানিত চারটি মাস রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমে সূরা তাওবায় বলেছেন,
ان عده الشهور عند الله اثنا عشرة شهرا-منها أربعة حرم
অর্থাৎ, আল্লাহ তা্আলার নিকট আরবি মাস হলো বারোটি। এর মধ্যে চারটি মাস রয়েছে যা অনেক সম্মানিত। সূর্যের হিসেবেও মাস হল বারটি তবে আল্লাহ তা’আলা চন্দ্রের হিসেবে বারটি মাসের কথা বলেছেন। যার মধ্যে চারটি মাস হল অনেক সম্মানিত। আর কী সেই চারটি মাস? সে সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সম্মানিত চারটি মাস হল, রজব, মুহাররম, জুল ক্বয়াদা ও জুল হিজ্জা।
আর আরবি বারটি মাসের মধ্যে প্রথম মাসটি সম্মানিত একটি মাস দ্বারা শুরু হয়, আর তা হল মুহাররম। এরপরের দ্বিতীয় সম্মানিত মাস হল এই ৭ নম্বর মাস রজব। এরপর আরবি ১১ এবং ১২ নাম্বার মাস, অর্থাৎ আরবি বারটি মাসের মধ্যে সর্বশেষ যে দুটি মাস রয়েছে । আর তা হল, জুল ক্বয়াদা ও জুল হিজ্জা। এই চারটি মাস হল অনেক সম্মানিত মাস।
এই চারটি হারাম মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করে খতীব সাহেব বলেন, আল্লাহ তা্আলা বলেন,
فلا تظلم فيهن على انفسكم.
অর্থ, এই চারটি মাসে তোমরা কেউ নিজেদের উপরে জুলুম-অত্যাচার করবে না! নিজেদের উপর অত্যাচার করা সব সময় নিষেধ। তবে আল্লাহ তা্আলা এই আয়াতে বুঝাতে চেয়েছেন, নিজের উপর অত্যাচার করা তো সব সময় নিষেধ; বিশেষকরে এই চারটি মাসে তোমরা কেউ নিজেদের উপরে জুলুম-অত্যাচার করবে না। এখন কথা হল কোন ব্যক্তি কিভাবে নিজের উপরে জুলুম করে?
আল্লাহ তা্আলার পক্ষ থেকে যা নিষিদ্ধ বা কোন গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়াই হলো নিজের উপরে জুলুম করা। অর্থাৎ, অন্যান্য মাসে তোমরা যে গুনাই করেছ বিশেষ করে এই চারটি মাসে তোমরা আল্লাহ তা্আলার কোন নাফরমানি করবে না।
জুলুম-নির্যাতন, অন্যের মাল অন্যায় ভাবে আত্মসাৎ করা, কারো ইজ্জত নষ্ট করা সবগুলাই নিজেদের উপর জুলুম। তাই এগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে বিশেষ করে এই চারটি মাসে।
এ ধরনের কাজ আমরা যেখানেই থাকি না কেন সব জায়গায় হারাম, তবে বিশেষ করে হারাম শরীফে এ ধরনের কাজ করা আরো মারাত্মক খারাপ। হারাম শরীফ মানে কী? আমরা অনেকে হারাম শরীফ মানে মনে করি মসজিদের ভেতরের অংশ। তবে আসল হারাম শরীফ হল কাবা শরীফের চতুর্দিকে যে মসজিদটি সেটি হল হারাম শরীফ। আগে আরো অনেক বড় এলাকা জুড়ে ছিল এটি। জেদ্দা থেকে আমরা যখন হারাম শরীফের দিকে যাই তখন হারাম শরীফের জায়গাটি দেখা যায়।
মদিনা যাওয়ার রাস্তায় তানঈম নামের যে মসজিদটি অর্থাৎ, যেটিকে মসজিদে আয়েশা বলা হয়। সেই তানঈম পর্যন্ত হলো হারামের অংশ। এরকম বড় এলাকা জুড়ে হারামের জায়গা নির্ধারণ করা আছে। হারাম শরীফের মসজিদের বাইরে হাজির আছে নিচ তলায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন সেটাও হারাম শরীফের অংশ।
মুহতারাম আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহ বলেন, হারাম শরীফ মূলত অনেক বড় তবে বিশেষ একটি জায়গা আছে হারাম শরীফের। সেটা হল বাইতুল্লাহ এবং বাইতুল্লাহর আশেপাশে যেই মসজিদ রয়েছে সেটি। এটি হলো মক্কার হারাম শরীফ। এমনিভাবে মদিনাতে একটি হারাম শরীফ আছে। আর তা হল মসজিদে নববী এবং মসজিদের নববীর চারপাশে একটা জায়গা নির্ধারিত রয়েছে সেটি। তবে মসজিদে নববী বিশেষ করে হারাম শরীফের অন্তর্ভুক্ত। এর দ্বারা বোঝা গেল হারাম শরীফ দুটি, একটি হল মক্কার হারাম শরীফ আরেকটি হল মদিনার হারাম শরীফ।
তাই সকল প্রকার গুনাহের কাজ খারাপ কাজ সব জায়গায় হারাম তবে বিশেষ করে এই সমস্ত হারাম শরীফে এটা আরো জঘন্য এবং আরো কঠিন। অন্যথায় জুলুম, অত্যাচার, পাপ এটা সব জায়গায় গুনাহ। এটা আল্লাহ তাআলার গজব নাজিলের মাধ্যম এবং আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়।
এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা এই চারটি মাসকে সম্মানিত ও হারাম করেছেন। যেন আমরা এই চারটি মাসে গুনাহ থেকে বাঁচার প্রশিক্ষণ নিতে পারি। এগুলোকে আল্লাহ তায়ালা অনেক সম্মানিত করেছেন। এর বাইরে আরেকটি সম্মানিত মাস হল রমজান মাস। সেই রমজান মাসকে আল্লাহ তাআলা এই চারটি মাসের বাইরে আরো সম্মানিত করেছেন। সেটা আরো সম্মানিত এবং ফজিলতপূর্ণ মাস। তাই আমরা যদি প্রতিজ্ঞা করি যে এই সম্মানিত মাসগুলোতে আমরা কোন গুনা করব না বা কোন অপরাধ করব না তাহলে বাকি বছরের মাসগুলোতে আমরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারবো বা সেটা আমাদের জন্য সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
রজব মাসে দোয়া ও রমজানের প্রস্তুতি সম্পর্কে শায়েখ বলেন, কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এই মাসে বারবার একটি দোয়া পড়তে বলেছেন। আর তা হল,
اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا في رمضان
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আপনি রজব এবং শাবান মাসে আমাদের উপর আপনার বরকতের বারিধারা বর্ষণ করুন এবং আমাদের হায়াতকে রমজান পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করুন!
অর্থাৎ, আল্লাহ! আমাদের হায়াতের ভিতরে বরকত দান করুন যাতে আমরা রমজান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি। এতে বুঝা গেল রমজানের অনেক ফজিলত রয়েছে। মুমিন বান্দা সব সময় রমজানের অপেক্ষায় থাকে, যেন তারা রমজানকে ঈমান আমলে কাটাতে পারে এবং আখেরাতে সফলকাম হতে পারে। তাই আমরা অপেক্ষায় থাকবো যে, রমজান কবে আসে। পাশাপাশি সেই রমজানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখবো।
রমজানের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আবার অনেকেই প্রশ্ন করে রমজানের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নিব? আসলে রমজানের জন্য আলাদা কোন প্রস্তুতি নেই। ঈমানী জীবন যাপন করলে সেটাই হলো রমজানের প্রস্তুতি। মুমিনের জীবন সর্বদা গুনাহ মুক্ত হবে। তাই এই রমজান মাসের প্রস্তুতি হবে তওবা করে পাক সাফ হয়ে পরিপূর্ণ ঈমানের সাথে রমজানে প্রবেশ করা ও রমজানকে ইসতেকবাল করা। এটাই হলো রমজানের সবচেয়ে ভালো প্রস্তুতি।
রমজান পবিত্র মাস। এই মাসে আমাদের উচিত সেহরি এবং ইফতার যেন হালাল উপার্জিত অর্থে হয়, সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা। খাবারের মধ্যে সুদের অর্থ, ঘুষের অর্থ, আত্মসাৎ বা চুরির অর্থ যেন না মেশে, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ হারাম উপার্জিত অর্থে সেহরি বা ইফতার করলে আমাদের রোজা কীভাবে কবুল হবে?
রমজানে শুধু খাবারই নয়, আমাদের পোশাক, পানাহার এবং বাসস্থানের ক্ষেত্রেও হালাল নিশ্চিত করা উচিত। আসলে এটি শুধু রমজানের প্রস্তুতির অংশ নয়, বরং সারা জীবনই আমাদের এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। কারণ, হারাম উপার্জিত অর্থ দিয়ে শুধু রোজাই কবুল হবে না এমন নয়; আমাদের দোয়া ও ইবাদতও কবুল হবে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ফরজ আদায় হবে না। আবার কেউ যদি মনে করেন, যেহেতু হারাম থেকে বাঁচতে পারছেন না, তাই নামাজ পড়ে লাভ নেই—এই ধারণাও ভুল। বরং এমন চিন্তা করলে দ্বিগুণ গুনাহ হবে। তাই নামাজ পড়ুন এবং আল্লাহর দরবারে দোয়া করুন যেন হালাল উপার্জনের পথ খুঁজে পান।
আল্লাহ তায়ালা কোরআনে এরশাদ করেছেন:
“ومن يتق الله يجعل له مخرجا”
অর্থাৎ, যে আল্লাহকে ভয় করবে এবং তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য মুক্তির পথ খুলে দেবেন।
তাই আমাদের উচিত আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখা এবং চেষ্টা করা। যদি আমরা সত্যিই আল্লাহর ভয়ে হালাল পথে চলার জন্য সচেষ্ট হই, তবে আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের জন্য হালাল রোজগারের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমাদের জীবনে যত হারামের সংস্পর্শ আছে, তা ধীরে ধীরে ত্যাগ করতে হবে। এজন্য সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
রমজানের প্রস্তুতির মধ্যে আরও একটি বিষয় হলো, আমরা যেন এই মাসে ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগী হতে পারি। রমজানের আগে আমাদের কাজগুলো গুছিয়ে নেয়া উচিত, যাতে ব্যস্ততার কারণে ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটে। তারাবির নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়া জরুরি নয়, তবে এশার নামাজ জামাতে পড়া উচিত। এরপর বাড়ি, অফিস বা সুবিধামতো স্থানে তারাবির জামাত করা যেতে পারে। এতে কোনো সমস্যা নেই।
রমজান হলো আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস। তাই আমাদের উচিত, হালাল পথে থেকে রমজানের প্রতিটি ইবাদত কবুল করার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা।
রমজানে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়া এবং সম্ভব হলে খতম তারাবি আদায় করা অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়। এ উদ্দেশ্যে রমজানের আগেই কাজগুলো গুছিয়ে নেয়া এবং ব্যস্ততা কমিয়ে আনার জন্য একটি রুটিন তৈরি করা উচিত। রমজানে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সারা বছর প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত, তবে রমজান মাসে এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া সুন্নত।
রমজানে যেন ইবাদত-বন্দেগি সুন্দরভাবে করা যায়, সেজন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা করা জরুরি। রমজানে তেলাওয়াত বাড়ানো, তারাবি পড়া, তাহাজ্জুদ আদায় করা—এগুলোকে নিয়মিত করার জন্য একটি রুটিন তৈরি করে তা অনুসরণ করা উচিত। এভাবে আমরা রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে ইবাদতে কাজে লাগাতে পারি, যা সারা বছরের আমলের জন্য একটি প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দোয়া করেছেন:
“اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان”
অর্থাৎ, “হে আল্লাহ, আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।”
এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে:
“وكل عبادي يقول التي هي احسن ان الشيطان ينزغ بينهم ان الشيطان كان للانسان عدوا مبينا”
অর্থাৎ, “হে নবী, আমার বান্দাদের বলে দিন যেন তারা সুন্দর কথা বলে, উত্তমভাবে কথা বলে। শয়তান তাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করতে চায়। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।”
সুতরাং ভালো কথা বলা, সুন্দরভাবে কথা বলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তেজনাপূর্ণ বা কঠিন কথা বলা থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ তা অন্যকে কষ্ট দেয় এবং কষ্ট দেয়া কবিরা গুনাহ। পরিবার, বাজার, ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যেও এ নিয়ম প্রযোজ্য। গালমন্দ বা অন্যায় কথা বললে মানুষ কষ্ট পায়, যা আল্লাহর কাছে বড় অপরাধ।
তবে ইনসাফের কথা বলার সময় যদি কেউ কষ্ট পায়, তাহলে আল্লাহ আমাদের ধরবেন না। এ ক্ষেত্রে আমাদের উচিত সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু তা অবশ্যই সুন্দর ও শালীন ভাষায়। আল্লাহ আমাদের এই নির্দেশ পালনের তাওফিক দান করুন।
আল্লাহ আমাদেরকে বলে দিয়েছেন,
وكل عبادي يقول التي هي احسن ان الشيطان ينزغ بينهم ان الشيطان كان للانسان عدوا مبينا
হে নবী, আপনি আমার বান্দাদের বলুন, তারা যেন সুন্দর কথা বলে এবং সুন্দরভাবে বলে। কারণ অসুন্দর কথা বলা হলে এর প্রতিক্রিয়ায় কেউ উত্তেজিত হতে পারে এবং তা থেকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এমনটি হলে শয়তান সুযোগ নেবে এবং মানুষের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে থাকবে। এ থেকে গীবত, অপবাদ এবং বিবাদ বাড়তে পারে।
এই বিধান বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যখন দুই ব্যক্তির মধ্যে মতভেদ হয়। মতভেদ স্বাভাবিক, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, মতভেদের কারণে অশালীন আচরণ বা অমার্জিত কথা বলার সুযোগ রয়েছে। এমনকি যদি মতভেদ গুরুতর হয় এবং কেউ গোমরাহির পথে চলে যায়—যার অর্থ পথহারা হওয়া, অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পথ ছেড়ে বিদআতের দিকে চলে যাওয়া—তবুও তার সঙ্গে শালীন ও মার্জিত আচরণ করতে হবে। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সুন্নতের পথ আমাদের জন্য রেখে গেছেন, তা ছেড়ে অন্য পথে যাওয়া বিদআত এবং বিদআতই গোমরাহি।
যদি কেউ পুরোপুরি ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, তাকেও ইসলামের পথে ফিরে আসার দাওয়াত দিতে হবে। এ দাওয়াত হতে হবে মার্জিত ভাষায় এবং তার ব্রষ্টতা ও ভুল আকিদাগুলোর প্রতি দলিল-প্রমাণভিত্তিক আলোচনা করতে হবে। কোনোভাবেই আক্রমণাত্মক, ঘায়েলকারী বা অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। তার ভুলের প্রতি দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে, কিন্তু আচরণে শালীনতা বজায় রাখতে হবে।
যেসব ব্যক্তি ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়নি, তবে যাদের মধ্যে ভুল ধারণা বা বক্র চিন্তা আছে, তাদেরকেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য দাওয়াত দিতে হবে। এ দাওয়াতও হতে হবে সুন্দর ও মার্জিত ভাষায়।
আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে দাওয়াতের সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। যদি হক কথা বলার কারণে কেউ কষ্ট পায়, তবে এটি তার সীমাবদ্ধতা। হক কথা অবশ্যই বলা উচিত, তবে তা হবে ন্যায্য ও শালীন ভাষায়। জাগতিক বিষয়ে দ্বন্দ্ব হোক বা ধর্মীয় বিষয়ে, সবক্ষেত্রেই সুন্দর ভাষায় কথা বলার এই নীতি অনুসরণ করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন:
“ربكم اعلم بكم ان يرحمكم وان يشاء يعذبكم وما ارسلناك عليهم وكيلا”
অর্থাৎ, “তোমাদের রব তোমাদের ব্যাপারে সর্বাধিক অবগত। তিনি যাকে ইচ্ছা দয়া করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। আর আমি আপনাকে তাদের তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাইনি।”
আরও বলা হয়েছে:
“يا ايها الذين امنوا اتقوا الله وقولوا قولا سديدا”
অর্থাৎ, “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।”
এই দুটি আয়াত আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করা উচিত। এভাবে আমরা অশালীন আচরণ ও অপমানজনক কথা বলা বন্ধ করতে পারি এবং একটি কল্যাণময় পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সঠিক কথা বলো। এর অর্থ হলো, অন্যায়, ভুল কিংবা মিথ্যা কথা এড়িয়ে চলা এবং সত্য কথা বলা। তবে সত্য কথাও যেন সুন্দরভাবে, শালীন ভাষায় বলা হয়। এই বিধান আমার ঘরে, বাজারে, অফিসে, আদালতে কিংবা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সব জায়গায় প্রযোজ্য। আমাদের ভাষা হতে হবে মার্জিত এবং ভদ্র। আল্লাহ আমাদের এই পথে পরিচালিত হওয়ার তৌফিক দান করুন।
শেষকথা হলো, যদি আমরা চাই বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করতে, তাহলে প্রথমে আমাদের তেলাওয়াত সহি-শুদ্ধ করতে হবে, যাতে আয়াতের অর্থ বদলে না যায়। কারণ আরবি ভাষায় এমন কিছু অক্ষর রয়েছে, যেমন: ح, ض, ع, ص, যেগুলোর সঠিক উচ্চারণের কাছাকাছি শব্দও বাংলায় নেই। আবার এমন কিছু অক্ষরও রয়েছে, যেগুলো বাংলার সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে। তবে পরিপূর্ণ হয় না। সামান্য কয়েকটি শব্দ আছে যা বাংলার সাথে মিলে। তাই যাদের তেলাওয়াত শুদ্ধ, তাদের কাছে গিয়ে শিখতে হবে এবং বারবার অনুশীলন করতে হবে। এজন্য কুরআনের তেলাওয়াত সহি-শুদ্ধ করার চেষ্টা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দান করুন।