নিউজনেস্ট

৭ই অক্টোবরের মাস্টার মাইন্ড ইয়াহইয়া সিনওয়ারের বিপ্লবী জীবন

৭ই অক্টোবরের মাস্টার মাইন্ড ইয়াহইয়া সিনওয়ারের বিপ্লবী জীবন
৭ই অক্টোবরের মাস্টার মাইন্ড ইয়াহইয়া সিনওয়ারের বিপ্লবী জীবন

ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম হামাস প্রধান ইয়াহইয়া সিনওয়ার। দীর্ঘ কারাবাসের মধ্য দিয়ে যিনি একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছেন বিশ্বব্যপী।

জন্ম ও শৈশব

১৯৬২ সালের ৭ই অক্টোবর, গাজার খান ইউনিসের একটি শরণার্থী শিবিরে ইয়াহইয়া সিনওয়ার জন্মগ্রহণ করেন।  সিনওয়ারের পরিবার ১৯৪৮ সালের নাকবার পরে গাজার মাজদাল শহর থেকে স্থানান্তরিত হন। উল্লেখ্য, গাজার এই মাজদাল শহরই বর্তমানে ইসরাইলের দখলকৃত ‘আসকালান’ শহর। শরণার্থী শিবিরের কঠিন পরিবেশ এবং ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর অত্যাচার ইয়াহইয়াকে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিরোধের পথে নিজেকে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। সিনওয়ার গাজার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং আরবি সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।

রাজনীতিতে পদার্পণ

ইয়াহইয়া সিনওয়ার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইসলামি ব্লক নামে একটি ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এখান থেকেই তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার সময় হামাস গঠিত হলে তিনি শীর্ষ নেতাদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। তিনি শায়েখ আহমদ ইয়াসিন রাহিমাহুল্লাহর নির্দেশে ‘মাজদ’ নামে একটি নিরাপত্তা সংস্থা গঠন করেন, যার কাজ ছিল ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর গুপ্তচরদের শনাক্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া। এই সংস্থাটি হামাসের সামরিক শাখার প্রাথমিক কাঠামো হিসেবে কাজ করে।

গ্রেফতার ও কারাবাস

ইসরাইল ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে বহুবার গ্রেফতার করে। ১৯৮২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রথম গ্রেফতার করে ইসরায়েল। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে ইসরায়েলি দুই সৈন্যকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে তাকে ৪ বার যাবজ্জীবনে মোট ৪২৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি ফিলিস্তিনি বন্দিদের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এবং লেখাপড়া ও গবেষণা অব্যাহত রাখতেন। এই সময়ে তিনি বেশ কয়েকটি বই ও অনুবাদ রচনা করেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ আশ শাবাক বাইনাল আশলা’ এবং ‘শোক আল কারনাফুল’।

অসলো চুক্তি ও সামরিক সংগ্রাম

লেবাননের সাবেক কমিউনিস্ট সংগ্রামী নাবিহ আওয়াদ, যিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সিনওয়ারের সঙ্গে কারাগারে ছিলেন, তিনি জানান সিনওয়ার অসলো শান্তি চুক্তির ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি এই চুক্তিকে ‘বিপর্যয়কর’ ও ইসরায়েলের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখতেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করা।

আওয়াদ আরও বলেন, সিনওয়ার হামাস বা হিজবুল্লাহর প্রতিটি আক্রমণের খবর শুনে উচ্ছ্বসিত হতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন  সামরিক সংগ্রামই ফিলিস্তিনের মুক্তির একমাত্র উপায়। তার মতে, ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ ছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ।

কারাগারে নেতৃত্বের গুণাবলী ও আত্ম-উন্নতি

কারাগারে থাকাকালীন সিনওয়ার ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য কাজ করা ফিলিস্তিনি বন্দিদের জন্য একজন আদর্শ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এমনকি যারা ইসলামি মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না, তারাও সিনওয়ারের নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হতেন। সিনওয়ার কারাগারে থাকাকালীন ইসরায়েলের শিন বেট তথা ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ব্যবস্থার গুপ্তচরদের শনাক্ত করার জন্য কাজ করতেন এবং তার তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি ও নেতৃত্বের দক্ষতা দিয়ে সফলভাবে অনেক গুপ্তচরকে চিহ্নিতও করেন। এছাড়া কারাগারে থাকাকালীন সময় তিনি হিব্রু ভাষা শিখেন এবং এতে দক্ষতা অর্জন করেন। ব্যক্তি হিসেবে ইয়াহইয়া সিনওয়ার ফিলিস্তিনকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। কেমন ছিল সেই ভালবাসা? সেটা সিনওয়ারের জীবনের একটি গল্প থেকে বেশ বুঝে আসে। 

একবার জেলখানায় সিনওয়ার খালি পায়ে টেবিল টেনিস খেলার সময় বলেছিলেন, ‘আমার খালি পায়ে হাঁটা আমার ইচ্ছার প্রতিফলন। আমি ফিলিস্তিনের মাটিতে আমার পা রাখতে চাই। আমি বন্দি নই, আমি আমার নিজের মাটিতে আছি। আমি এখানে আমার দেশে স্বাধীন।’ এই কথাটি তার প্রতিরোধের অঙ্গীকার ও ফিলিস্তিনের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার প্রতীক।

মুক্তি ও নেতৃত্বের পথে যাত্রা

২০১১ সালে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি ‘ওয়াফা আল আহরার’ এর অধীনে সিনওয়ারকে মুক্তি দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, এই চুক্তির অধীনে ইসরায়েলি সৈন্য গিলাদ শালিতকে মুক্তির বিনিময়ে ১০২৭ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর সিনওয়ার পুনরায় হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জুদ্দিন আল কাসসাম ব্রিগেডের নেতৃত্বে ফিরে আসেন। ২০১৭ সালে তিনি হামাসের রাজনৈতিক দপ্তরের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০২১ সালে পুনরায় এই পদে নির্বাচিত হন।

তুফানুল আকসা ও সিনওয়ার

২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে তুফানুল আকসা নামে একটি অপারেশন পরিচালনা করে। ইসরায়েলি বাহিনী এই হামলার জন্য ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে দায়ী করে। এরপর তাকে হত্যা এবং গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইসরায়েল শুরু করে অপারেশন আয়রন সোর্ড।

আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

২০২৪ সালের ২০শে মে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ২০২৩ সালে তুফানুল আকসার সময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের(?) জেরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ ইয়াহইয়া সিনওয়ার এবং হামাসের অন্য কয়েকজন নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।

ইসমাইল হানিয়ার হত্যার পর হামাসের নেতা

২০২৪ সালের ৩১শে জুলাই ইসরায়েলি বিমান হামলায় হামাসের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া শাহাদাত বরণ করেন। তার মৃত্যুর পর, ২০২৪ সালের ৬ই আগস্ট হামাসের শুরা কাউন্সিল ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে নতুন নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে। এর মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতৃত্বে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু করেন।

টার্গেট ও হামলা

হামাসের প্রধান হওয়ার পরপরই ইয়াহইয়া সিনওয়ার ইসরায়েলের প্রধান টার্গেটে পরিণত হন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রও সিনওয়ারকে সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এর আগে অবশ্য ইসরায়েল সিনওয়ারের নেতৃত্বকে হুমকি হিসেবে দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার আক্রমণ পরিচালিত করে। বিশেষ করে ইসরায়েল ২০১২, ২০১৪ এবং ২০২১ সালে সিনওয়ারের বাড়িতে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল।

২০২৩ সালে তুফানুল আকসা অপারেশনের পর, সিনওয়ার ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তিতে পরিণত হন। অবশেষে, গত ২০২৪ সালের ১৭ই অক্টোবর রাফার তিল আস সুলতান এলাকায় সংঘর্ষের সময় ইসরায়েলি বাহিনী তাদের অজান্তেই সিনওয়ারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। দেরীতে হলেও এ সংবাদের সত্যতা হামাসও নিশ্চিত করে ঘোষণা দিয়ে জানায়, দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

আতাউল্লাহ আয়মান
+ posts

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত