২০২৪ সালের ধর্মীয় অঙ্গন নানা পরিবর্তন ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে আলোচনায় ছিল। ইসলামী আন্দোলন, সংগঠনগুলির মধ্যে সংকট, সামাজিক প্রভাব, এবং শিক্ষামূলক সাফল্য—সব মিলিয়ে এই বছরটি একদিকে যেমন ইসলামী চিন্তাধারায় গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, অন্যদিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটেও নতুন কিছু ধারণা সৃষ্টি করেছে। আসুন, এক নজরে ২০২৪ সালের ইসলামী অঙ্গনের প্রধান ঘটনা ও কর্মসূচিগুলি জেনে নেওয়া যাক।
১. হাফেজদের বিশ্বজয় : আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় সাফল্য
২০২৪ সালের বিভিন্ন সময় বাংলাদেশি হাফেজরা আন্তর্জাতিক কোরআন ও কিরাত প্রতিযোগিতায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ, হাফেজ আনাস মাহফুজ, হাফেজ বশির আহমাদ এবং হাফেজ আনাস বিন আতিক—এরা সকলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল হাফেজ তানভির আহমাদ, হাফেজ আম্মার বিন মাসুম, এবং হাফেজ মুশফিকুর রহমান, যাদের সাফল্যে বাংলাদেশ আবারও কোরআন হাফেজদের বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করেছে।
২. ইসলামী অঙ্গনে প্রথম আলেম উপদেষ্টা
২০২৪ সালে ১০ এপ্রিল দেশের সরকার ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো আলেম উপদেষ্টা পদ সৃষ্টি করা হয় এবং মাওলানা আ ফ ম খালিদ হোসেনকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাওলানা আ ফ ম খালিদ হোসেন ইসলামী শিক্ষায় একটি বড় নাম। তাঁর এই পদে নিয়োগ দেশের ইসলামী সমাজের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। এর মাধ্যমে আলেম সমাজের সরকারে সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং ইসলামিক চিন্তাধারা সরকারের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষ
২০২৪ সালে ২০ সেপ্টেম্বর বায়তুল মোকাররম মসজিদে মাওলানা রুহুল আমিনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যার ফলে বেশ কয়েকজন মুসল্লি আহত হন। বাইতুল মোকাররমের সাবেক খতিব মাওলানা রুহুল আমিন মসজিদে জুমার নামাজ পড়াতে গেলে কিছু মুসল্লি তাঁকে বাধা দেন, এবং এর জেরে মসজিদে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মাওলানা রুহুল আমিনের সন্ত্রাসী বাহিনীর নৃশংস হামলার এই ঘটনা বাংলাদেশের ধর্মীয় সমাজে এক বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করে ।
৪. বায়তুল মোকাররমে নতুন খতিব নিয়োগ
২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর, বায়তুল মোকাররম মসজিদের নতুন খতিব হিসেবে মুফতি আব্দুল মালেক সাহেবকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি একজন বিশিষ্ট ইসলামিক পণ্ডিত এবং তার নেতৃত্বে মসজিদে নতুন দিশা ও শান্তির পরিবেশ ফিরে আসে। মুফতি আব্দুল মালেক সাহেবের নেতৃত্ব ইসলামী সমাজে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
৫. জুলাই অভ্যুত্থানে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভূমিকা এবং আন্দোলন
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, যার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম নেয়। মাদরাসা ছাত্ররা বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে নামলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ৭০ জন শিক্ষার্থী শহীদ হন। এই ঘটনাটি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও ধর্মীয় সমাজে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা হয়।
৬. তাবলীগ জামাতের শূরায়ে নেজামপন্থিদের মহাসম্মেলন
২০২৪ সালে তাবলীগ জামাতে বিভাজন আরও গভীর হয়। মাওলানা সাদ কান্ধলভী ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে শূরায়ে নেজামপন্থি আলেমরা ২০২৪ সালের ৫ই নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী ময়দানে একটি মহাসম্মেলন আয়োজন করেন। যে সম্মেলনে লক্ষাধিক মুসলিম জনতার সমাবেশ ঘটে। এতে তারা তাবলীগ জামাতের ঐক্য ফেরানোর আহ্বান জানান। এই সম্মেলনটি ইসলামী সমাজে এক নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করে।
৭. সাদপন্থীদের নৃশংস হামলা
২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ব ইজতেমায় আবারও তাবলীগ জামাতের সাদপন্থী গ্রুপ শূরায়ে নেজামিপন্থীদের ওপর হঠাৎ হামলা চালায়। এই হামলায় শূরায়ে নেজামীপন্থীদের ৩ জন নিহত হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। এই ঘটনার পর থেকে সাদপন্থীদের আসল রূপ সকলের সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়। পাশাপাশি কাকরাইল মসজিদসহ বিশ্ব ইজতেমায় তাদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
৮. মাহফিলের মঞ্চে বিতর্কিত বক্তব্য
২০২৪ সালে ইসলামি বক্তা আমির হামজা এবং ইসলামী বক্তা তাহেরীর কিছু বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে সামাজিক মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। আমির হামজা সিনেমার নায়িকা সম্পর্কে মন্তব্য করলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। পাশাপাশি তাহেরী পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে মন্তব্য করলে তা তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোনা জারি হয়।
৯. হজের খরচ ও হাজীদের মৃত্যু
২০২৪ সালের হজে যাওয়া হাজীদের খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা নিয়ে সাধারণ মুসলিম সমাজের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এদিকে বাংলাদেশি হাজীদের জন্য সরকার নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করলেও তা কার্যকর হয়নি। এছাড়া, হজ করতে গিয়ে তাপমাত্রার কারণে কিছু বাংলাদেশি হাজী মারা যান।
১০. ইসলামী বইমেলা
২০২৪ সালে প্রথমবারের মতো ব্যাপক জায়গা জুড়ে ও শান শওকতের সাথে ইসলামী বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে প্রচেষ্টা চালানোর পরে ইসলামী বইমেলা এবারের বছর বিশেষভাবে সফল হয়। ২৭ ডিসেম্বর শুরু হওয়া বইমেলায় ইসলামী চিন্তাধারা, কোরআন, হাদিস, তাফসিরসহ অন্যান্য ইসলামিক বিষয়াবলি নিয়ে নতুন বই প্রকাশিত হয়। এই মেলা মুসলিম সমাজে ইসলামী সাহিত্য ও শিক্ষা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়। এই বইমেলা ফলে মুসলিম সমাজের তরুণদের মধ্যে ইসলামি সংস্কৃতি ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
১১. আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের সাহায্য
২০২৪ সালের বন্যার পর, ফেনী জেলার বিভিন্ন এলাকায় আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ব্যাপক সহায়তা প্রদান করে। তারা ১৩০ কোটি টাকা দান করে এবং ১০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন সাহায্য প্রদান করে। এবং শত শত পরিবারকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী সহ অটো রিক্সা কিনে দেয়। পাশাপাশি ফাউন্ডেশনটি ইসলামী চিন্তাধারা অনুযায়ী মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
১২. বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে সাজা প্রাপ্ত আলেমদের মুক্তি
২০২৪ সালে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে হাজার প্রাপ্ত অসংখ্য আলেম মুক্তি পান। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মাওলানা মামুনুল হক, হারুন আল ইজহার সাহেব, জসিম উদ্দিন রহমানিসহ হেফাজতের আরো অনেক নেতৃবৃন্দ।
১৩. মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর দেশে ফিরে মাহফিল শুরু
২০২০ সালে দেশ ছাড়লেও ২০২৪ সালের অক্টোবরে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারি দেশে ফিরেন। সম্প্রতি তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে মাহফিল করতে শুরু করেছেন। এই মাহফিলে হাজারো মানুষের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় এবং ইসলামিক বয়ান প্রদান করেন।
১৪. ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার হন ২৫ নভেম্বর। এর পরের দিন চট্টগ্রামের আদালতপাড়ায় তার অনুসারীদের হাতে খুন হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস এক সময় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) নেতা ছিলেন এবং ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি, শিশু নির্যাতনসহ চারিত্রিক স্খলনজনিত অভিযোগও বেরিয়ে আসে তার বিরুদ্ধে।
এমন এক ব্যক্তিকে আইনি প্রক্রিয়ায় নিতে বাধা ও বিভিন্ন উসকানিমূলক মন্তব্য ছড়ানোর প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সেখান থেকে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি উঠে আসে। একই সঙ্গে আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদ এবং খুনিদের দ্রুত বিচারের দাবি করা হয়।
১৫. ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন দেয়ার কারণে দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা
এপ্রিলে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় দুই যুবককে মন্দিরে আগুন দেয়ার সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করার পর তা দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সারা দেশে এ হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। ঢাকা ও খুলনা মহাসড়কে অবরোধ করাও হয়।
উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নে এক মন্দিরের পাশে স্কুলের নির্মাণশ্রমিক কাজ করছিলেন। সে সময় মন্দিরে আগুন লাগলে শ্রমিকদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং তাদেরকে পেটানো হয়। এ সময় দুজন নিহত হন। এ ঘটনার পর ফরিদপুর এক সপ্তাহেরও বেশি বিজিবি টহলে ছিল।
২০২৪ সাল ইসলামী অঙ্গনের জন্য একটি রূপান্তরিত বছর ছিল, যেখানে নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, চ্যালেঞ্জ, ও অগ্রগতির সাক্ষী ছিল। ইসলামী সমাজের মধ্যে এইসব ঘটনা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার সূচনা করল, যা ভবিষ্যতে ইসলামী চিন্তাভাবনা এবং প্রথায় আরো বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে।